ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

সরকারের ব্যাংকঋণ ॥ ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে কী?

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১২ জুন ২০১৫

সরকারের ব্যাংকঋণ ॥ ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে কী?

বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ৪ জুন আসন্ন ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। ব্যয়ের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের বাজেটের মোট আকার ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। শুধু উন্নয়ন বাজেট অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আকার যদি বিবেচনা করি তাহলে এর আকারও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার মতে, এই ‘এডিপি’ই বাজেটের আসল কথা। কারণ রাজস্ব ব্যয় মেটানোর পর যে টাকা থাকে তার সঙ্গে কিছুটা ঋণের টাকা যোগ করে অর্থায়ন করা হয় ‘এডিপি’ যা উন্নয়নের কথা বলে। দেখা যাচ্ছে সেই ‘এডিপি’র আকার আগামী অর্থবছরে হবে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সংশোধিত ‘এডিপি’র আকার হবে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। তাহলে ‘এডিপি’ বৃদ্ধি পাচ্ছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বাজেটের এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দেখা যাচ্ছে আমাদের বাজেটটি একটি ঘাটতি বাজেট। এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। বরাবরই এটা ঘটে এসেছে। বাজেট করার যথেষ্ট অর্থ আমাদের নেই, বিশেষ করে উন্নয়ন বাজেটের। এটাও কোন দোষণীয় বিষয় নয়, যতক্ষণ না সরকার ঋণ করে ঘি খায়। ঋণ করে সেই টাকা উন্নয়নের জন্য খরচ করলে সমস্যা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা একটা আছে। তা হচ্ছে ব্যয়ের গুণ বা ‘এক্সপেন্ডিচার কোয়ালিটি’। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার ওপর নজর রাখা দরকার। এক টাকার উন্নয়নের জন্য যদি দুই টাকা খরচ করতে হয় তাহলে সেই উন্নয়ন হয় অপচয়ের মধ্যে উন্নয়ন। এটা হলেই বিপদ। আমাদের ক্ষেত্রে এই বিপদ যে নেই তা নয়। এই ঘটনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ যখন ঋণের টাকা উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়। দশ টাকা ঋণ করে যদি ৫ টাকার উন্নয়ন হয়, আর ৫ টাকা অপচয় হয় তাহলে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের হার অর্জন করতে দ্বিগুণ সময় লাগবে। এই বিষয়টি ভিন্ন অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অন্যদিন তা আলোচনা করব। উপস্থিত ক্ষেত্রে আমি বাজেটের একটি মাত্র দিক নিয়ে আলোচনা করব। আর সেটা হচ্ছে ব্যাংকঋণ সম্পর্কে। বাজেট ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ‘এফবিসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট মাতলুব আহমাদ একটা গুরুতর অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না। এই আশঙ্কার ভিত্তি কতটুকু? এ বিষয়ে যাওয়ার আগে একটি কথা বলা দরকার। বাজেটপূর্বকালে ব্যবসায়ীরা, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সরকারের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তোলে। সরকার সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি দিয়ে ঋণ করছে। খবরের কাগজগুলো সঞ্চয়পত্রের ওপর দিনের পর দিন প্রতিবেদন ছেপে বলেছে, সরকার সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার বেশি। এটা কমাতে হবে। এটা ছিল ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি, যা অনেক ‘অর্থনীতিপড়া’ লোকজনও সমর্থন করেন। দেখা গেল সরকার তাদের কথা রেখেছে। সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস করেছে সরকার। বাজেটে দেখলাম ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে কম ঋণ করবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ঋণ নিয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর এই খাত থেকে সরকার ঋণ করবে মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা। তাহলে প্রশ্নÑ বাকি টাকা সরকার কোত্থেকে আনবে? ঋণ তাকে করতেই হবে। তাহলে বাকি থাকে তিনটি উৎস : কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বিদেশী ঋণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকার দেখা যাচ্ছে বিদেশ থেকে ঋণ নেবে ২৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা বর্তমান বছরে মাত্র ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এর থেকে বোঝা যায় সরকার বিদেশী ঋণ বাড়াবে। তারপরও তার ঋণ দরকার। সরকার কী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে? প্রশ্নই ওঠে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর একটা বড় কারণ। এটা জরুরী অথবা আপৎকালীন ঋণ হতে পারে। কোন সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের প্রতি আকর্ষিত হয় না। তাহলে বাকি থাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক। সেখান থেকেই সরকার এবার ঋণ নেবে। মজা হচ্ছে বর্তমান বছরের তুলনায় সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নেবে মাত্র ৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার স্থলে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, সরকার সঞ্চয়পত্রের ঋণ কমিয়ে বাড়াচ্ছে বিদেশী ঋণ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ। আমার মতে তা সহনশীল অনুপাতেই। এখানে ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণ কী? তারা কী সরকারকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ করতে দেবে না, সঞ্চয়পত্র থেকেও ঋণ দেবে না, বিদেশী ঋণ নিতেও দেবে না। বিদেশী ঋণ বাড়লে ‘প-িতরা’ ক্যালকুলেটর নিয়ে বসবে এবং বলবে, সরকার মাথাপিছু বিদেশী ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে চলছে। এতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা পড়বে বিপদে। তাহলে করণীয় কী? করণীয় হচ্ছে সরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অধিক হারে কর আদায় করা। এটাই তো সরকার চাইছে। পোশাক শিল্পের রফতানিতে পূর্বতন কর কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবার তা আরোপ করা হয়েছে। আবার হৈ-চৈ। পোশাক রফতানীকারক এবং বস্ত্রশিল্পের মালিকরা সম্মেলন করে বলেছেন, এটা হবে না। আমাদের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে। এবার পাঠক বুঝুন-কী করণীয়? করণীয়, উপায়ন্তর না দেখে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া। সরকার ইতোমধ্যেই বর্তমান বছরে ব্যাংকগুলো থেকে ৩১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর বেশি নেবে মাত্র ৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এখানে প্রথম প্রশ্ন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা আছে কীনা, দ্বিতীয় প্রশ্ন এই টাকা নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণে টান পড়বে কীনা? লেজে আরেকটা প্রশ্ন, সরকারী ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে উৎসাহিত কী-না? সরকার সাধারণভাবে বেসরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় না। সরকারী ব্যাংকগুলো থেকেই নেয়। বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ, বড় বড় ঋণপত্র খোলা ইত্যাদির জন্য সরকার ঋণ নেয়। এতে সুদের হার অবশ্যই কম। কিন্তু সরকার ঋণ ‘খেলাপী’ হয় না। এটা সরকারী ব্যাংকের বড় লাভ। সরকারী ঋণ পুরোপুরি নিশ্চিত ঋণ। বেসরকারী ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোকে হরহামেশাই পস্তাতে হয়। বিপুল পরিমাণ টাকার ঋণ খেলাপী হয়। এর বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখতে হয়। অতএব ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে খুব বেশি দ্বিধান্বিত নয়। ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণ দেয়ার মতো টাকা আছে কীনা? এই মুহূর্তে ব্যাংকে ব্যাংকে বিশাল তারল্য। ঋণ নেয়ার মতো লোক নেই। ‘কলমানি মার্কেটে’ যা আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেট বলে পরিচিত সেখানে কোন গ্রাহক নেই। ব্যাংকগুলো এখন কোন আমানত নিতে চায় না। আমানত নিলে তার ওপর সুদ দিতে হবে। সুদের টাকা আসবে কোত্থেকে। ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসা কোথায়? এর জন্য আমানত নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশে ব্যাংকগুলো দলবেঁধে আমানতের ওপর সুদের হার কমাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঋণের ওপরও সুদের হার কমাচ্ছে। ফলে ‘স্প্রেড’ হ্রাস পাচ্ছে। ‘স্প্রেড’ মানে অর্জিত সুদ এবং পরিশোধিত সুদের পার্থক্য। এটা ভাল লক্ষণ। সকল ব্যাংক এখন ঋণ প্রদান ক্ষেত্রে নানা রকম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোটামুটি সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে। এ করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতিকে একটা সহনীয় পর্যায়ে রেখেছে। ঋণের বাজার মন্দা এবং আমানতের বাজারে মন্দার কারণে ডলারের মূল্যও স্থিতিশীল আছে। এই মুহূর্তে আমার কাছে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের (একসেস লিক্যুইডিটি) হিসাবটা নেই। তবে তা যে বিপুল পরিমাণের তাতে আমার কোন সেন্দহ নেই। পাঁচ শত, হাজার, দুই-তিন হাজার কোটি টাকা ফান্ড সারপ্লাস এমন ব্যাংক প্রায় সবাই। অতএব সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণের অভাব হবে একথা মোটেই সত্য নয়। বস্তুত এই আশঙ্কার কোন ভিত্তি নেই এটা একটা গতানুগতিক সমালোচনার অংশ মাত্র। তর্কের খাতিরে ধরে নিই সরকার ঋণ নিলে ব্যবসায়ীদের ঋণের অভাব হবে। তাহলেও তো অসুবিধা নেই। ব্যবসায়ীরা সস্তায় ঋণ চায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো সেই ব্যবস্থা করেই দিয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে ঋণ আনছেন। ওখানে সুদের হার কম। সঠিক তথ্য বলতে পারব না, তবে ইতোমধ্যেই ডজনেরও অধিক ব্যবসায়ী কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ বিদেশ থেকে এনেছেন। কেউ কেউ আবার ঐ টাকা মেয়াদী আমানতে রেখেছেন। কেউ কেউ দেশী ব্যাংকের ঋণ ঐ টাকায় শোধও করেছেন। এসব কথা জানা। এত সস্তাই যদি বিদেশী ঋণ হয় তাহলে দেশী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার দরকার কী? বড় কথা, ভাল ব্যবসায়ী ঋণ পায় না এমন নজির ব্যাংকিং খাতে নেই। এই দুর্দিনেও অর্থাৎ বেসরকারী খাতে বিনিয়োগের দুর্দিনেও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন। পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার। আমাদের কর্পোরেট সেক্টর কিন্তু অতিরিক্ত ঋণের ভারে জর্জরিত। পাঁচশত কোটি টাকার ওপরে যাদের ঋণ আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ঋণ পুনর্গঠন করে নিতে বলেছে। অর্থাৎ তাদের যে ‘ক্যাশ ফ্লো’ তা দিয়ে ব্যাংকের টাকা তারা শোধ করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের একটা পরামর্শ দেব। দয়া করে আপনারা ব্যাংকঋণের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে যান। সেখান থেকে ফান্ড সংগ্রহ করুন। যারা বিদেশে টাকা রেখেছেন চুপিচুপি কিছু টাকা দেশে নিয়ে এসে ব্যবসা করুন। পারলে কিছু ব্যাংকঋণ শোধ করে ঋণের বোঝা কমান। এতে দেশের মঙ্গল ব্যাংকের মঙ্গল। ব্যবসায়ীদেরও মঙ্গল। শত হোক হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ রেখে ইহধাম ত্যাগ করলে ঐ বোঝা পড়বে ছেলেমেয়েদের ওপর। যেসব খবর শুনি তাতে মনে হয়, বড় বড় হাউসের অনেক মালিকের ছেলেমেয়েরা বিশাল ব্যবসা ধরে রাখার মতো উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠছে না। শত শত একর জমি রেখে গেলেও সেই জমির কিন্তু একসময়ে কোন ক্রেতা নাও পাওয়া যেতে পারে। ঈশ্বর করুন এমন অবস্থা না হোক। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×