ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতকে বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ায় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আসবে

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১১ জুন ২০১৫

ভারতকে বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ায় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আসবে

তৌহিদুর রহমান ॥ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী মাসুল নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ। এই দুই আন্তর্জাতিক নৌবন্দর দিয়ে ভারত তিনটি রুটে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। দুই বন্দর ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। অনুমোদিত রুটে ভারত পণ্য আনা নেয়ার জন্য জলপথ, রেলপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করতে পারবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে যেসব সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল এটি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সমঝোতা স্মারকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে ভারত ত্রিপুরার আগরতলা, মেঘালয়ের ডাউকি ও অসমের সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। এ ছাড়া দুই বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে এসব রুটে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য জলপথ, রেলপথ ও স্থলপথ ব্যবহার করতে পারবে। ঢাকায় মোদির সফরকালে এই সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে নৌ-সচিব শফিক আলম মেহেদী ও ভারতের পক্ষে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর সই করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য দ্ইু দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তবে এই সমঝোতায় মাসুল এখনও নির্ধারণ হয়নি। খুব শীঘ্রই দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মাসুল নির্ধারণ করবে। সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ এই প্রথম কোন দেশকে দুই বন্দর ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বন্দর ব্যবহারের জন্য মাসুল এখন নির্ধারণ হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী মাসুল নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব শফিক আলম মেহেদী বলেছেন, বাংলাদেশ ভারতকে তার পণ্য আনা-নেয়ার জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেবে। সমঝোতা স্মারকের আওতায় রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে আগরতলা, ডাউকি ও সুতারকান্দি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বন্দরগুলো যত বেশি ব্যবহার হবে তত বেশি আয় বাড়বে। আর সড়কপথে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান বা কন্টেনারে পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহৃত হবে বলেও জানান তিনি। ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতির বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দিলে বাংলাদেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। তবে মাসুল নির্ধারণ করতে হবে অনেক ভেবেচিন্তে। দু’পক্ষেরই যেন লাভ হয়, সেভাবেই মাসুল নির্ধারণ করতে হবে। তিনি জানান, মাসুল নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক অনেক নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া মাসুল নির্ধারণের জন্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থারও একটি নিয়ম রয়েছে। সেটাও অনুসরণ করা যেতে পারে। সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে মমতা বন্দোপাধ্যয় না আসায় তিস্তা চুক্তির সঙ্গে থেমে যায় আরও একটি চুক্তি। সেটি হলো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে অনুমতি বিষয়ক সম্মতিপত্র। সে সময় তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় এই চুক্তিও থেমে যায়। তবে এবার মোদির সফরে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত চুক্তি হওয়ায় বিভিন্ন চুক্তি সম্পন্নে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হয়। সে কারণে এবার বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতাও সই হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের দিল্লী সফরকালে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। সে সফরেই তিনি ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার আগ্রহের কথা ভারতকে জানান। সে সময় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও আলোচনা হয়। তার এক বছর পরে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না আসায় সে সময়ে ওই চুক্তিটি হয়নি। বাংলাদেশ আন্তঃযোগাযোগ বিষয়কে বিশেষভাবে জোর দিয়ে আসছে। ভারতকে এ অনুমতি দেয়ার পরে এশিয়ার অন্যান্য দেশও যোগাযোগের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করবে। যা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। প্রায় চার দশকের অমীমাংসিত স্থল সীমান্ত চুক্তি বিষয়ক সমস্যা ভারত সমাধান করে দিয়েছে। তিস্তার বিষয়েও দেশটির সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের দেখা মিলেছে। তাই এবার বাংলাদেশও কিছুটা উদারতা দেখিয়েছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সঙ্গে ভারতের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। ত্রিপুরার সাব্রুমের সঙ্গে বাংলাদেশের রামগড়ের যোগাযোগ স্থাপনে ভারত ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই ত্রিপুরার সাব্রুমে প্রবেশ করতে পারবে ভারতীয় পণ্য। এ ছাড়া আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেলসংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। এটি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মালবাহী ওয়াগন আখাউড়া হয়ে সরাসরি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় চলে যেতে পারবে। ত্রিপুরা ব্যবহার করে ভারতের ‘সেভেন সিস্টারখ্যাত বিভিন্ন রাজ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আনা-নেয়া করতে সক্ষম হবে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া-সিলেট হয়ে কমিরগঞ্জ সীমান্তের সুতারকান্দি দিয়ে সরাসরি অসমে যেতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটিকে পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য ৬৭৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ১২২ কোটি টাকা। বাকি ৫৫৬ কোটি টাকা ভারত সরকার বাংলাদেশকে ঋণ হিসেবে দেবে। রেল চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় মিটারগেজ রেলপথটি ২০০২ সাল থেকে বন্ধ আছে। এ অবস্থায় সাড়ে ৫১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ রেলপথটিকে আরও ৯ কিলোমিটার বাড়িয়ে ভারতীয় সীমান্ত করিমগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়াল গেজে রূপান্তরিত করে চালু করলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আঞ্চলিক রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক উভয়ের সঙ্গেই যুক্ত হতে পারবে। ফলে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটবে। এ পথটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া-সিলেট হয়ে করিমগঞ্জ সীমন্ত দিয়ে সরাসরি অসমে প্রবেশ করতে পারবে। এছাড়া খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার ফলে মংলা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মংলা থেকে সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ যাওয়ার পথ তৈরি হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। তার মধ্যে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক ছিল অন্যতম। এছাড়া দু’শ’ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা, সীমান্ত চুক্তির দলিল বিনিময়, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে সরাসরি বাস সেবা চালু, ঢাকা-শিলং বাস সেবা চালু, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ও নবায়ন, নৌ ট্রানজিট প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নবায়ন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, মানবপাচার চুক্তি, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অঞ্চল সমঝোতা চুক্তি, পণ্য রফতানিতে দুই দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে চুক্তি, সন্ত্রাস দমন বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের কোস্ট গার্ডের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা, মুদ্র জালিয়াতি প্রতিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সার্কের জন্য ভারতের অনুদান নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। দুই দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নয়া দিল্লীর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ইন্ডিয়ার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর এবং বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরাসহ দুই দেশের কর্মকর্তারা এসব চুক্তিতে সই করেন। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ৬-৭ জুন ঢাকা সফর করেন। সফরকালে ঢাকা আসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ঢাকা সফরে এসে নরেন্দ্র মোদি তিস্তা ও ফেনীর নদীর পানি সমস্যা সমাধানেও আশ্বাস দিয়েছেন।
×