ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল বারী

মোদির সফর সম্পর্কের ভিত্তি আরও দৃঢ় হল

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১০ জুন ২০১৫

মোদির সফর  সম্পর্কের ভিত্তি আরও দৃঢ় হল

ঢাকায় নিজস্ব ক্যারিশমা দিয়ে নানা মহলকে বুঁদ করে রেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তার দিল্লী ফেরার পর আমরা কী পেলাম, ভারত সব নিয়ে গেলÑ এ নিয়ে স্বাভাবিক গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। দল হিসেবে এ নিয়ে সবার আগে প্রশ্ন তুলেছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। বিএনপি তোলেনি। কারণ বিএনপি নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাত পেয়েছে, ভারতের তরফে কিছু সফট কর্নারের আশায় আছে। জামায়াত মোদির সাক্ষাত পায়নি, ভারতের কাছ থেকে তার পাবারও কিছু নেই। তাই প্রশ্ন তুলে সে হয়েছে প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট। এক বামপন্থী যুবক আমার ফেসবুকের ওয়ালের একটি পোস্টে মন্তব্য লিখতে গিয়ে মোদি মিশনের বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে জানতে চেয়েছেন। আমি তার নাম্বার চেয়েছিলাম কথা বলতে। তার বামপন্থী ভীরু হৃদয় নাম্বার দিতে ভয় পেয়েছে। আমাকে তার ইনবক্সে লিখতে বলেছে। শুধু একজনের জন্যে তার ইনবক্সে লিখে সময়ের অপচয় করতে আমার ইচ্ছা করেনি। রাজনীতিকরা অনেক কিছুর মতো তার স্বপ্ন-পরিকল্পনার ক্যানভাসারও। কে কত চমৎকারভাবে তার কথাগুলো উপস্থাপন করতে পারেন, এসব তাদের গুণাবলীর মধ্যে পড়ে। তা বারাক ওবামা থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি, হাসিনা-খালেদা-জামায়াত-বাম নেতা সবার ক্ষেত্রে সমান। আর সবকিছুর সঙ্গে অর্থনীতি জড়িত। কেউ কোথাও দানপাত্র খুলে বসেনি। জামায়াত নেতারা দল থেকে মাসোহারা পায়। এর জন্যে সময়ে সুযোগে নানান কিছুতে বিবৃতি দিয়েও যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, এসব তাদের মাসোহারার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বামপন্থী দলগুলোতে এখন মাসোহারার ব্যবস্থা চালু আছে কিনা জানি না। তবে চাঁদা সংগ্রহ চলে। ছাত্রলীগ ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আছে বলে চাঁদা বা টেন্ডারের জন্যে জবরদস্তি করে বলে সেটি হয় চাঁদাবাজি। চুপচাপ যারা চাঁদা তোলে সেটির ভদ্রনাম চাঁদা সংগ্রহ। এর সবই অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট। অর্থনীতির চেয়ে বড় সত্য বাস্তব জগতে দ্বিতীয়টি নেই। এক সময়কার হিন্দু মৌলবাদী ইমেজের নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের অর্থনৈতিক সাফল্যের গুণেই ইমেজ পাল্টে দিল্লীর মসনদ পর্যন্ত চলে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার সফরের ২০তম দেশ ছিল বাংলাদেশ। তার পিআর সেকশনটির গবেষণা-স্মার্ট উপস্থাপনার গুণে ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করে আগের ১৯টি দেশেও তিনি সবাইকে মোহিত করে এসেছেন। বাংলাদেশ সফরের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ দুটি কারণে বাংলাদেশ সফরটা স্পেশাল ছিল নরেন্দ্র মোদির কাছে। এ দেশটার জন্ম সময়ে যুবক হিসেবে সে যুদ্ধ তাকে আলোড়িত করেছিল। গুজরাটের গ্রাম থেকে মিছিল নিয়ে এসেছিলেন দিল্লী! আর ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যের কারণে। প্রধানমন্ত্রী মোদি এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার দুরূহ কাজটি করেছেন। সীমান্ত চুক্তি বিলটি ভারতের সব রাজ্য বিধানসভা এবং পার্লামেন্টে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হয়েছে। পার্লামেন্টে বিল পাসের প্রাক্কালে অনেক প্রবীণ সদস্য বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছেন। সেই চুক্তিটির আনুষ্ঠানিকতা সারতে ঢাকা এসেছিলেন মোদি। এর সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতা, নোয়াখালীতে গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত এলাকায়, পদ্মায় আড্ডা মারা, আড়ংয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা সবকিছুর সংযোজন ঘটিয়েছে তার স্মার্ট পিআর টিম। আপনি ক্যানভাসার, কিছু সেল করতে গেলে তো গ্রাহক এলাকার মানুষজনের প্রশংসা করে তাদেরকে পক্ষে নিতেই হবে। চীনে গিয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টসে দ্বিতীয় হয়ে যাবার গল্পটা সেভাবে এসেছে। এসেছে সাকিব-সালমা আর এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশের দুই নারীর নাম। বাংলাদেশে এখন ভারতের জন্যে নিরাপদ একটি সরকার ক্ষমতায় আছে। কারণ বিএনপি সরকার তাদের বিস্তর ব্যবসা দিলেও ভারত বিরোধী তথা পাকি জঙ্গীদের আশ্রয়, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানে জড়িয়ে ভারতীয়দের আস্থা হারিয়েছে। আবার মোদি এমন সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন যখন ভারতবিরোধী রাজনীতির কা-ারি বিএনপি নামের দলটাও তাদের কৃপাপ্রার্থী। তাদের সঙ্গে থাকা ভারতবিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন শফিউল আলম প্রধানের মতো নেতাদের মুখে টেপ পরিয়ে রেখেছেন খালেদা জিয়া। এর আগে নিজের ডাকা হরতালে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে দেখা করেননি বিএনপি চেয়ারপার্সন। আর এবার ঢাকার যানজটের কারণে যদি সময়মতো মোদি দর্শনে না যেতে পারেন সে কারণে আগেভাগেই কাওরানবাজারে এসে বসেছিলেন। মোদির সফরে ভারত পেয়েছে বেশি, সেটি সত্য। তিস্তা চুক্তি পশ্চিমবঙ্গের আগামী বছরের বিধান সভা নির্বাচনের আগে হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, যে বেল্টে তাদের তিস্তা নদী সেই বেল্টের এমপিরা কংগ্রেসের। আমি মোদির জায়গায় থাকলে বিশেষ একটি অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়ে মমতাকে তিস্তা চুক্তিতে রাজি করাতে চাইতাম। ওই প্যাকেজে তিস্তা চুক্তিতে কোন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব থাকত। ঢাকায় নজিরবিহীনভাবে মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন মোদি। আমার ধারণা, তাকে এ ধরনের কোন প্রণোদনায় রাজি করানোর চেষ্টা হতে পারে। তিস্তা চুক্তিটা আমাদের খুব দরকার। মোদিও জানেন বাংলাদেশের আরও বেশি মন পেতে দরকার তিস্তার ফয়সালা। শেষ পর্যন্ত তিস্তার ব্যাপারটি ঝুলে থাকলেও এ ব্যাপারে আন্তরিক মোদিকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এবার মোদির সফরে ভারতের সবচেয়ে লাভের বিষয়টি হলো ট্রানজিট। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট ট্রানজিটের উপযোগী নয়। এখন এই রাস্তাঘাট বানানো বা উপযোগী করার টাকাটা ভারত থেকে আসবে। কাজ পাবে বাংলাদেশের মানুষ। আগে ট্রানজিট আলোচনায় শুল্কের বিষয়টি ছিল না। এখন শুল্কের বিষয়টি আসায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। সীমান্ত চুক্তির পর মোদির সফরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন বিদ্যুত চুক্তি। ভারতীয় বড় দুটি কোম্পানির বিদ্যুত যেদিন ন্যাশনাল গ্রিডে আসবে সেদিন অনেক বদলে যাবে বাংলাদেশ। আমার এক বন্ধু প্রশ্ন তুলে লিখেছেনÑ বিদ্যুতের চুক্তি হয়ে গেল; কিন্তু এ নিয়ে কোন প্রাক আলোচনা কেউ টের পেল না। এসব বিষয়ে আমি দিল্লীর একটি ওয়াকিফহাল সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছি। সূত্রটি বলেছে, বিদ্যুত আলোচনার বিষয়টি তারা জানতেন। কিন্তু কোন পক্ষই চায়নি এটি চুক্তির আগে প্রকাশ হোক। যে কোন কিছু ভ-ুল হতে সময় লাগে না। গত বিএনপি আমলে টাটা-বিড়লার বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল তখনকার সরকার। পরে সেই বিনিয়োগ হয়েছে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটে। যে কোন বিদেশী কোম্পানির লোকাল এজেন্ট অবশ্যই কেউ না কেউ হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। এখানে তো বিএনপি-জামায়াতের কেউ লোকাল এজেন্ট হবে না। এটা নিয়ে রহস্য খুঁজে তো লাভ নেই। আমাদের দরকার বিদ্যুত। বিদ্যুতের গায়ে তো লেখা থাকবে না এটা হিন্দু বিদ্যুত না মুসলমান বিদ্যুত। ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার চিন্তা করে লাভ নেই। সেটা বোকামিও হবে। তার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রেখে যেখান থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা যাই পাওয়া যাবে তাতেই লাভ বাংলাদেশের। কারণ অবকাঠামো, ভারতে এবং সারা দুনিয়ার বাজারের কারণে তার ইন্ডাস্ট্রিগুলো অনেক বড়। সেগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে কম। তারা পণ্য অনেক সস্তায় বিক্রি করতে পারে। সারা দুনিয়ার ভোক্তারাই খোঁজে কোন্্টির দাম কম। বাংলাদেশে যে গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটেছে এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশে মজুরি ভারতের চেয়ে কম। মজুরি ভারতে কম থাকলে আমরা এক্ষেত্রেও তাদের সঙ্গে পারতাম না। আমরা তো সব সময় সব বিগফিশের সঙ্গেই বুঝেশুনে কথা বলি। ইসরাইলের নিন্দা করি, তাদের সঙ্গে আমাদের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ইসরাইলের রক্ষাকবচ আমেরিকা, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কতই না মহব্বতের সম্পর্ক! সোহাগ-সম্মানসহ তাদের সঙ্গে কথা বলি। ভারত তো তাদের চেয়ে বড় না। কিন্তু সবকিছুতে ‘ভারত আইল ভারত খাইল’ বলতে বলতে আমরা অনেক কিছু শুরু করেছি দেরিতে। অথচ শান্তি চুক্তির পর তো ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক চালু হওয়াতে তো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি গোটা অঞ্চল। অথচ এসব নিয়ে ভারত জুজুর পলিটিক্স তো কম হয়নি। ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি হয়ে গেছে; কিন্তু এর প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত হরতাল ডাকা হয়নি বাংলাদেশে। এটি কী কয়েক বছর আগে ভাবা যেত? এখন কিন্তু সবকিছুর সঙ্গে বাংলাদেশও বদলেছে। এটা ইতিবাচক। আপনি সারা দুনিয়ার সব জায়গায় যেতে চাইবেন, সবার ভাল সবকিছু নিতে চাইবেন-দিতে চাইবেন আর ভারতের বেলায় শুধু শুচিবায়ুতে ভুগবেন, এটা তো কোন মানসিক সুস্থতা নয়। নানাকিছুতে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে, এগুচ্ছে, নিজে নিজে করে ফেলছে পদ্মা সেতু, এতে যে সত্যটি প্রমাণিত এবং প্রতিষ্ঠিত তাহলো বাংলাদেশ আর কারও গিলে খাওয়ার দেশ নয়। নরেন্দ্র মোদিও ভারতকে যেভাবে বদলে দিয়েছেন তাহলোÑ বাংলাদেশ থেকে কিছু পেতে চাইলে বাংলাদেশের মানুষকে ভালবাসতে হবে, আস্থায় নিতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস করিয়েছেন সীমান্ত চুক্তি। বাংলাদেশে এসেও তিনি দেখিয়েছেন কী করে একটি দেশের মানুষের হৃদয় জয় করতে হয়। এর মাধ্যমে তিনি অবশ্যই দেখেছেন ভারতীয় স্বার্থ। কারণ তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আমরাও কি আস্থার হাত প্রসারিত করে ভারত থেকে আদায় করে নেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করতে পেরেছি মোদির সফরের সময়! এটিও আমাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত সমাজ-রাষ্ট্রের বড় একটি অর্জন। এখান থেকে হেঁটে আমাদেরটা আমরা আরও সাহসীভাবে আদায় করার অভ্যাস বাড়াব। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে জয়ী একটা জাতি। আমাদের কেউ গিলে খেতে পারবে না কোন দিন। লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
×