ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা হলো ১৫০ বাংলাদেশীকে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ জুন ২০১৫

মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা হলো ১৫০ বাংলাদেশীকে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচ এম এরশাদ ॥ অবশেষে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সোমবার মিয়ানমার থেকে ফেরত আনা হয়েছে ১৫০ বাংলাদেশীকে। মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে অভিবাসী প্রত্যাশী হতে গিয়ে সম্প্রতি মিয়ানমার জলসীমা থেকে দু’দফায় যে ৯৩৫ জনকে সে দেশের নৌবাহিনী উদ্ধার করেছে এরা প্রথম দফার ২০৮ জনের দলটির। এদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ২৯, নরসিংদীর ৫৬, ঝিনাইদহে ১২, টাঙ্গাইলের ৩, চট্টগ্রামের ৮, চুয়াডাঙ্গার ৪, নারায়ণগঞ্জের ৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬, বান্দরবানের ৯, কুমিল্লার ১, চাঁদপুরের ১, রাজবাড়ীর ২, যশোরের ২, পাবনার ৫, বাগেরহাটের ৪, হবিগঞ্জের ১ এবং নাটোর জেলার ১ জন রয়েছে। অবশিষ্ট দুজন কোন এলাকার বাসিন্দা তা জানা যায়নি। সোমবার সকাল ১১টায় উখিয়ার সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঢেঁকিবনিয়ায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বিভাগের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে চিহ্নিত হওয়া ১৫০ বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছে। এ সময় মিয়ানমারের বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবি ১৭ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম। আর মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন মংডু ইমিগ্রেশন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর স নেয়ইং। বৈঠক শেষে ১৫০ বাংলাদেশীকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে সকাল পৌনে ১১টায় বাংলাদেশের পক্ষে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢেঁকিবনিয়ায় বৈঠক স্থলে পৌঁছেন। সীমান্ত এলাকায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে প্রতিনিধিদলের যাত্রা যেমন বিলম্বিত হয়েছে তেমনি পতাকা বৈঠক ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়ও বিলম্ব ঘটেছে। হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় বিজিবির সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও ইমিগ্রেশন বিভাগে প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বিজিবি সূত্র জানায়, বৈঠক শেষে বাংলাদেশী বলে শনাক্ত হওয়া ১৫০ জনকে গ্রহণ করা হয়। গত ২১ মে মিয়ানমার সাগর উপকূলে ভাসমান অবস্থায় সে দেশের নৌবাহিনী যে ২০৮ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করে এ ১৫০ জন সে দলের। হস্তান্তরিত হওয়ার পর এ ১৫০ বাংলাদেশীকে পুলিশ প্রহরায় কক্সবাজারে নিয়ে আসা হয়েছে। বেলা ২টায় ঘুমধুমের বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু দিয়ে প্রতিটি দলের ৩০ জন করে বাংলাদেশীরা ফেরত আসে। পরে ৬টি বাসে করে তাদের কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হয়। মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন অফিসার চ্যানাইন বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্টে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা নিজ দেশে ফেরত যাচ্ছে। এতে মিয়ানমার সরকার খুশি। এ সময় বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোঃ খালেকুজ্জামান জানান, নিশ্চিত হওয়ার পর ১৫০ বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হলো। পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত অবশিষ্টদের মধ্যে যারা বাংলাদেশী বলে নিশ্চিত হবে তাদেরও ফিরিয়ে আনা হবে। ফেরত আসা এসব বাংলাদেশীকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেনের উপস্থিতিতে পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথের হাতে হস্তান্তর করে বিজিবি। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ফেরত আসাদের স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হবে। কারও স্বজন পাওয়া না গেলে তাকে নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হবে। ফেরত বাংলাদেশীরা যা বলেছে ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু পার হয়ে এদেশে প্রবেশ করে গাড়িতে উঠার আগে হেঁটে যাওয়ার সময় কথা হয় ঝিনাইদহ ও ঢাকার দুই যুবকের সঙ্গে। তারা জানান, প্রায় ৯০ দিন আগে ওরা নিজ ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে নিজ নিজ বাসস্থান ত্যাগ করে দালালের খপ্পরে পড়ে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া রওনা হয়েছিল। অনেকে দুই মাস সময় পার করে দিয়েছে সাগরে। সাগরবক্ষে ট্রলারে প্রথম একমাস ধরে দিনে মাত্র এক বেলা খাবার ভাগ্যে জুটেছিল ওদের। তাও পেট ভরে নয়। পরবর্তী এক মাস সাগরের লোনাজল মুখে দিয়ে শুধু গলাটা ভিজা রেখে উপোস অবস্থায় কাটাতে হয়েছে ট্রলারে। গত ২১ মে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর হাতে উদ্ধার হয়ে ওরা সেদেশে কাটিয়েছেন ১৮ দিন। তারপরও সরকার তথা প্রশাসনের সহযোগিতায় নিজ দেশের মাটিতে পা রাখতে পেরে তারা অত্যন্ত খুশি। স্বপ্নের মালয়েশিয়া এখন তাদের কাছে আতঙ্কের নাম। আর দালাল চক্র হিংস্র পশুর সমতুল্য। ওইসব দালালের কালো হাত তছনছ করে দিয়েছে তাদের অনেকের সাজানো সংসার। এখন ওরা দালালদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছেন। যেভাবে তারা যাত্রা করেছিল ॥ ফেরত আসা ব্যক্তিরা অনেকে জানিয়েছে, দালালদের কাছে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্রথমে শুধু আগ্রহ দেখালেই কাজ হয়েছে। দালালরা ভাল বেতনে চাকরিসহ বহু লোভ দেখিয়ে ওইসময় জামাই আদরে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে ট্রলারে তুলে দিতে পারলেই তখন থেকে শুরু হয় মুক্তিপণের টাকা আদায়ের জন্য মারধর। শুধু সাগর পথে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়াগামী ভুক্তভোগীরা বুঝবেন তাদের নির্যাতনের সীমাহীন যন্ত্রণা কি। তারা আরও জানান, উখিয়ার রেজুখালের মুখ দিয়ে তাদের নৌকায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রলারে। ও সময় মুসলেম উদ্দিন নামের এক দালাল বলেছিল, ভয় এবং সমস্যা কিছুই নেই। বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষ স্থানীয় দালাল নিহত ॥ টেকনাফে মানবপাচারকারীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে তালিকাভুক্ত শীর্ষ স্থানীয় দালাল আমান উল্লাহ আনু নিহত হয়েছে। পুলিশ সূত্র জানায়, সোমবার ভোর ৪টায় হ্নীলা আলীখালী লবণ মাঠে মানবপাচারকারী চক্রের দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে অপরাপর মানবপাচারকারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ওই স্থান থেকে ১টি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে স্থানীয় রোহিঙ্গারা এসে লাশটি শনাক্ত করে। নিহত মানবপাচারকারী মোচনী নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ ব্লকের মোহাম্মদ শফির পুত্র বলে জানা গেছে। টেকনাফ থানার ওসি মোঃ আতাউর রহমান খোন্দকার জানান, নিহত আনুর বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় ৬টি মামলা রয়েছে। উস্কানিদাতা দুই রোহিঙ্গা গ্রেফতার ॥ উখিয়া ও ক্যাম্প পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছৈয়দ আলম ও মোঃ ইউনুছ নামে দুই রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে। রবিবার রাতে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার শত শত ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে একদল চক্রান্তকারী রোহিঙ্গা। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাম্প্রতিক মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যার নামে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া শতশত ভুয়া ছবির অধিকাংশই শ্রীলঙ্কার তামিল হত্যাকা-, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফ্রিকা বা অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকা- কিংবা দুর্ঘটনা থেকে নেয়া ছবি। মালয়েশিয়ায় আরও ৯৯ নরকঙ্কাল উদ্ধার ॥ মালয়েশিয়ার পেরলিস প্রদেশের গভীর জঙ্গলে আবিষ্কৃত অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের গণকবর থেকে সোমবার আরও ৯৯টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করেছে সে দেশের পুলিশ। গণকবর থেকে উদ্ধার তৎপরতা এখনও চলছে। বন্দীশালাগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। গণকবর খুঁড়ে লাশ বা কঙ্কাল বের করতে যথেষ্ট সময়ও যেমন নিচ্ছে তেমনি বেগ পেতেও হচ্ছে। মিয়ানমারে ৯০ পাচারকারী গ্রেফতার ॥ মিয়ানমার পুলিশ এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৯০ মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে রাখাইন প্রদেশের কেউ নেই। মিয়ানমারের পুলিশ তথ্য দিয়ে জানিয়েছে, মানবপাচারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫৬টি মামলা হয়েছে।
×