ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রাম কুমিল্লা নোয়াখালীতে সঙ্কট চলছে ॥ ভয়াবহ গ্যাস বিপর্যয়

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৯ জুন ২০১৫

চট্টগ্রাম কুমিল্লা নোয়াখালীতে সঙ্কট চলছে ॥ ভয়াবহ গ্যাস বিপর্যয়

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নতুন একটি সিদ্ধান্তের জের হিসেবে সারাদেশে ভয়াবহ গ্যাস বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। গত প্রায় ৫ দিন ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে এ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে শিল্প প্রতিষ্ঠান, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ও চট্টগ্রামের একটি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে গ্যাসশূন্যতার সৃষ্টি হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) পেট্রোবাংলা, তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানিসহ তেল সেক্টরে বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দশটি বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানি কন্ডেনসেট গ্রহণ ব্যাপকভাবে হ্রাস করায় বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহ লাইনে দেয়া যাচ্ছে না। কেননা, গ্যাস উত্তোলনের সময় যে পরিমাণ কন্ডেনসেট উঠে আসে তার মজুদ ক্ষমতা বাড়তি না থাকার কারণে গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে পেট্রোবাংলা। আর এ গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় তা ঢাকার বিভিন্ন অংশে, চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং নোয়াখালী, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে গ্যাস শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত চুলা যেমন জ্বলছে না তেমনি গ্যাসনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোর অধিকাংশ এখন বন্ধ রয়েছে। বিপুলসংখ্যক সিএনজি ফিলিং স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আঘাত হেনেছে গ্যাসচালিত যানবাহন সেক্টরে। এছাড়া রাউজান তাপবিদ্যুত কেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় বিদ্যুত উৎপাদন হ্রাস পেয়ে চট্টগ্রামের লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি ও কুমিল্লার বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিঃসহ গ্যাস সেক্টরের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, বিপিসির সিদ্ধান্তহীনতায় গত প্রায় ৫ দিন ধরে দেশের উল্লিখিত স্থানসমূহে গ্যাস বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে বিপিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে পত্র দেয়ার পরও সোমবার পর্যন্ত এর কোন উন্নতি ঘটেনি। এদিকে, পেট্রোবাংলা সূত্রে জানানো হয়, বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড থেকে উত্তোলিত কন্ডেনসেট সংরক্ষণে ধারণক্ষমতা এখন অতিক্রম করেছে। কিন্তু বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলো ইতোপূর্বে যেভাবে কন্ডেনসেটের সরবরাহ নিয়ে আসছিল তা তারা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, সরকারী পর্যায়ের নিরীক্ষা বিভাগ তাদের অডিট আপত্তিতে তুলে ধরেছে এই বলে যে, গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদিত কন্ডেনসেট সরাসরি বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর পরিবর্তে বিপিসির মাধ্যমে বিপণন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ অডিট আপত্তির পর চলতি বছরের প্রথমদিক থেকে বেসরকারী কোম্পানিগুলোতে সরাসরি কন্ডেনসেট সরবরাহ দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় বিপিসি গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলিত কন্ডেনসেট গ্রহণ করে তা সংস্থার নিয়ন্ত্রিত তিন তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মাধ্যমে সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হয়। মূল বিপত্তিটি ঘটেছে বেসরকারী গ্যাস কোম্পানিগুলোতে কন্ডেনসেট পরিশোধন করে তা আবার বিপিসির মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারি ও তিন তেল কোম্পানিকে সরবরাহের ক্ষেত্রে কমিশন বা মার্জিন হিসেবে যে অর্থ পাওয়া যেত তা অর্ধেকে নেমে আসার জের। বেসরকারী তেল বিপণন কোম্পানিগুলো তাদের আর্থিক লাভ হ্রাস পাওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলিত কন্ডেনসেট সরবরাহ নেয়া একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। এতে বিবিয়ানায় কন্ডেনসেটের মজুদ ধারণ ক্ষমতা ছুঁই ছুঁই হওয়ায় জাতীয় গ্যাস গ্রিডের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে সিলেটের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, বেসরকারী দশটি রিফাইনারি ইতোপূর্বে সরাসরি কন্ডেনসেট সরবরাহ নিয়ে তা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে পুনঃ সরবরাহের প্রক্রিয়ায় লিটারপ্রতি ৭ থেকে ৮ টাকা কমিশন বা মার্জিন পেত। এতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে আসছিল। কিন্তু নিরীক্ষা বিভাগের আপত্তির কারণে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিপিসির মাধ্যমে এ কন্ডেনসেট গ্রহণ করে তা পুনরায় বেসরকারী রিফাইনারিগুলোকে সরবরাহের প্রক্রিয়ায় তাদের মার্জিন বা কমিশন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। এতে এসব বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানি কন্ডেনসেট গ্রহণে ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে দফায় দফায় বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সুরাহার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। বিপিসি অডিট আপত্তি নিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তে রয়েছে অটল। প্রসঙ্গত, বর্তমানে আগের চেয়ে বছরে প্রায় ৪ লাখ টন বাড়তি কন্ডেনসেট উৎপাদনের টার্গেট নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এই কন্ডেনসেট ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বেসরকারী দশটি রিফাইনারির প্রসেসিং প্ল্যান্টের মাধ্যমে পরিশোধন করে পুনরায় বাজারজাত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গ্যাস বিপর্যয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চল। গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত চুলাসহ গ্যাসনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। বাসা-বাড়ি, হোটেল, রেস্তরাঁতে গ্যাসের চুলা জ্বলছে না বললেই চলে। গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোতে উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি অধিকাংশ সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস না থাকায় গ্যাসচালিত বিভিন্ন যানবাহন ব্যাপক সঙ্কটে পড়েছে। এছাড়া গ্যাসের চাপ হ্রাস পাওয়ায় রাউজান তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে দুটি ইউনিটের মধ্যে একটিতে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের কেন্দ্র শিকলবাহা বিদ্যুত কেন্দ্রে বিদ্যুত উৎপাদন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে গ্যাস সঙ্কটের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের মাত্রাও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ের ঘটনা ঘটছে। সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩ হাজার এমএমএসএফডি হলেও সরবরাহ হয়ে আসছিল প্রায় ২৩শ’ এমএমএসএফডি গ্যাস। এই অবস্থায়ও দেশের বিভিন্ন স্থানেও গ্যাস সঙ্কট চলে আসছে। কিন্তু গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় যেসব কন্ডেনসেট আসে তা সরবরাহের প্রক্রিয়ায় আরও প্রায় ৪শ’ এমএমএসএফডি গ্যাস কমে যাওয়ায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। উত্তোলিত কন্ডেনসেট মজুদ রাখার ক্ষেত্রে সংকুলান না থাকায় এসব কন্ডেনসেট সংরক্ষণ ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আর এ কারণেই গ্যাস উত্তোলনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা আঘাত করেছে। অর্থাৎ গ্যাস উত্তোলন হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র কর্তৃপক্ষ অভিভাবক সংস্থা পেট্রোবাংলার নির্দেশে। সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিপিসির সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ বিপর্যয় ও দুর্ভোগ এখন চরমে। বর্তমানে জাতীয় গ্রিড লাইনে প্রায় ৪শ’ এমএমএসএফডি গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় আবাসিক, শিল্প, সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে এবং দুটি বিদ্যুত কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিপিসি এ ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে এলে এ সঙ্কট থাকে না। এ ব্যাপারে বিপিসি সূত্রে জানানো হয়েছে, বিষয়টি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। সরকারী নিরীক্ষা বিভাগের অডিট আপত্তির কারণে বিপিসি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলিত কন্ডেনসেট সরাসরি গ্রহণ করে তা পুনরায় বেসরকারী রিফাইনারিগুলোতে সরবরাহের সিদ্ধান্তে কার্যকর করেছে। এ সিদ্ধান্ত তাদের নিজের নয়। পুরো বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ওপর নির্ভর করে। এদিকে, বেসরকারী রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর একটি সূত্রে জানানো হয়েছে, আগে যে কন্ডেনসেট পরিশোধন প্রক্রিয়ায় তারা লিটারপ্রতি ৭ থেকে ৮ টাকা মার্জিন/কমিশন পেত বিপিসি সরাসরি গ্রহণ করায় তা এখন সর্বোচ্চ লিটারপ্রতি ৪ টাকায় নেমে এসেছে। এতে এসব বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ায় লাভবান হতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা কন্ডেনসেট গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। অপর একটি সূত্র জানায়, ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত বেসরকারী রিফাইনারিগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। ফলে এ প্রক্রিয়ায় কন্ডেনসেট গ্রহণ তারা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে। চট্টগ্রামে আবাসিক গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্নস্থানে অনুরূপ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস প্রথম সরবরাহ হয় ঢাকা অঞ্চলে। এর পরে আসে দেশের অন্যান্য স্থানে। এদিকে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাসনির্ভর হোটেল-রেস্তরাঁর চুলা জ্বলছে না, শিল্পগুলো গ্যাস শূন্যতায় উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে ‘গ্যাস নেই’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে গ্যাসনির্ভর যানবাহনগুলো গ্যাস সঙ্কটে পড়ে। যেসব স্টেশনে এখনও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোতে দীর্ঘ লাইনে সারিবদ্ধ হচ্ছে। গ্যাস সঙ্কটে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে গ্যাস সেক্টরের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে সোমবার সন্ধ্যায় জানানো হয়েছে, বিপিসির সিদ্ধান্ত না পাল্টালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে কথা বলে বিপিসির এ ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশজুড়ে গ্যাসের এই সাময়িক সঙ্কট দূরীকরণে তৎপর হওয়া উচিত।
×