ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ জুন বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও ভুটানের সড়ক যোগাযোগ চুক্তি ;###;মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের নতুন অধ্যায় ॥ সড়কবদ্ধ ৪দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ জুন ২০১৫

আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের নতুন অধ্যায় ॥ সড়কবদ্ধ ৪দেশ

এম শাহজাহান ॥ আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে সড়কপথে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল সংক্রান্ত চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এই অনুমোদনের ফলে মূলত বহু প্রতীক্ষিত চারদেশীয় ট্রানজিট চুক্তির বিষয়টি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। আগামী ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে যাত্রী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষর হবে। ভবিষ্যতে এই চার দেশের সম্মতিতে যোগাযোগে অন্য যে কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগও চুক্তিতে রাখা হয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ট্রানজিট সুবিধা গ্রহণ ও প্রদান করা হবে। সাতটি সড়ক, সাতটি রেল ও তিনটি নৌপথ দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেয়া হবে। এই পথগুলোর মাধ্যমে ট্রানজিট সুবিধা দিতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে অবকাঠামো উন্নয়ন ও পথগুলো ট্রানজিটের উপযোগী করার জন্য। এতে পরিবহন বাবদ ১৫ ধরনের মাশুল আদায় করতে পারবে বাংলাদেশ। আর তাতে বছরে আয় হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া চারদেশীয় ট্রানজিটের ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ খসড়ার অনুমোদন দেয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা সাংবাদিকদের বলেন, সড়কপথে যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলের জন্য বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিকল এ্যাগ্রিমেন্ট (এমভিএ)’ স্বাক্ষরের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। তিনি বলেন, চুক্তির খসড়া অনুযায়ী চার দেশের মধ্যে চলাচলে রুট পারমিট নিতে হবে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার সময় মাঝপথে কোন যাত্রী বা মালামাল তোলা যাবে না। যে দেশের ওপর দিয়ে যানবাহন যাবে, সেই দেশের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তা সার্চ ও ইন্সপেকশন করতে পারবে। কোন দেশে যদি একটি পণ্য নিষিদ্ধ থাকে তাহলে সেই দেশের ওপর দিয়ে ওই পণ্য পরিবহন করা যাবে না বলেও চুক্তির খসড়ায় রয়েছে। তিন বছর পর পর এই চুক্তি নবায়ন হবে। কোন দেশ চাইলে ৬ মাসের নোটিস দিয়ে চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে পাররে। চুক্তির আওতায় যান চলাচলের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ নিজেদের নির্ধারিত হারে ট্রানজিট ফি আদায় করবে। উদাহারণ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি নেপাল থেকে বাংলাদেশে একটি যানবাহন প্রবেশ করে তাহলে ভারত ও বাংলাদেশকে ফি দিতে হবে। ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চুক্তি ও পরে প্রটোকল স্বাক্ষর হওয়ার পর শীঘ্রই চুক্তি অনুযায়ী যানবাহন চলাচল শুরু হবে। এর আগে এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপের আদলে এই চার দেশের মধ্যে ২০১৬ সাল মোটরযান চলাচল শুরু করা যাবে। এছাড়া সামরিক শাসনামলের নৌবাহিনী নিয়ে তিনটি অধ্যাদেশ একত্র করে একটি আইনের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এ লক্ষ্যে সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘নেভি (এ্যামেন্ডমেন্ট) এ্যাক্ট, ২০১৫’ এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। জানা গেছে, বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে চারদেশীয় এই ট্রানজিট চুক্তির বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। তবে রাজনৈতিক সঙ্কট সামলাতে গিয়ে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার আর এগোতে পারেনি। সরকারের ধারবাহিকতা বজায় থাকায় যেখানে শেষ করে রাখা হয়েছে সেখান থেকেই আবার ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আলোচনা শুরু করে বর্তমান সরকার। এক্ষেত্রে বাণিজ্য, নৌ-পরিবহন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট বিষয়টি ফের তদারকি শুরু করে। এছাড়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে এই চুক্তিটি দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেন। বাংলাদেশ সফরে এসে রবিবার বিদায় নেয়ার আগে বিশেষ বক্তৃতায়ও মোদি আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং চারদেশীয় সড়ক যোগাযোগ চুক্তির বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। আর এ কারণে চলতি মাসেই চুক্তিটি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। এদিকে ট্রানজিট চুক্তির মূল কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশ। চারদেশীয় এই ট্রানজিট চুক্তির বিষয়ে খুঁটিনাটি ঠিক করার জন্য সরকার তার আগের মেয়াদেই একটি কোর কমিটি করেছিল। সেসময় ওই কমিটি সম্ভাব্য রুট, অবকাঠামো উন্নয়ন ও এ খাতে ব্যয়সহ অর্থনৈতিক সমীক্ষা তৈরি করে। কমিটির ওই সুপারিশে ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায় করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সেই সময় ট্রানজিটের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে ৪৯ হাজার ৯২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে সড়ক রুটে উন্নয়নে ১১ হাজার ৯৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা, রেলপথ উন্নয়নে ৩২ হাজার ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা, নৌপথ উন্নয়নে ১ হাজার ১৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরে। এছাড়া চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ১ হাজার ৮৫০ কোটি ৯০ লাখ টাকা, মংলা সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং স্থলবন্দরের উন্নয়নে ১৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নের এ অর্থায়ন কোন খাত থেকে এবং কীভাবে আসতে পারে কিংবা ব্যয় করা যেতে পারে তারও সুনির্দিষ্ট উপায় নির্দেশনা দেয়া হয় কোর কমিটির সুপারিশ মালায়। মাশুল আদায় প্রসঙ্গে ওই সময় বলা হয়, বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহারের জন্য মালামাল বহনকারী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিবহনের অবস্থানের সময়, যাতায়াতের দূরত্ব, লোডিংয়ের পরিমাণ, দুর্ঘটনা, পরিবেশ বিপর্যয় এ জাতীয় ইন্ডিকেটরের আন্তর্জাতিক মানদ- বিবেচনায় নিয়ে মাশুল আদায় করা যেতে পারে। সূত্র জানায়, ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দ্বিপক্ষীয় ট্রানজিট সম্পর্ক তৈরির ওপর বরাবরই জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেটিকে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ সম্পর্ক হিসেবে না দেখে আঞ্চলিক যোগাযোগের ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ট্রানজিট সংক্রান্ত রূপরেখা তৈরির সময় কোর কমিটির রিপোর্টে ভারত, নেপাল ও ভুটান ৩টি দেশকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে সড়ক পথে যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টি নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। এই চুক্তি কার্যকর হলে ভারতের ভূখ- ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রফতানি করা যাবে। ফলে দেশের রফতানি বাণিজ্যও সম্প্রসারণ হওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। এছাড়া ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নিতে হলে তাতেও মাশুল আদায় করা যাবে। সবমিলিয়ে এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র এই চার দেশ নয়, নতুন করে বিসিআইএম করা হচ্ছে। ওটি হলে আঞ্চলিক বাণিজ্যে নতুন করে যুক্ত হবে চায়না এবং মিয়ানমার। সেটিও করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রূপকল্প-২১ বাস্তবায়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে যেতে হলে এখন এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে পড়ছে। চুক্তি কার্যকর হলে যা পাবে বাংলাদেশ ॥ আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে প্রতিবেশী চার দেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করা হলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে তা নিয়ে কাজ করছে এ সংক্রান্ত কোর কমিটি। এছাড়া সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী কয়েকটি সংগঠনও এটি নিয়ে গবেষণা করছে। ইতোপূর্বে কোর গ্রুপ যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে অবকাঠামো বিনির্মাণ ও উন্নয়নসাপেক্ষে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন পণ্যবাহী কার্গো পরিবহন হবে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ট্রানশিপমেন্ট দেয়া হলে ১৮ লাখ টন কার্গো পরিবহন হবে। সাতটি সড়ক, সাতটি রেল ও তিনটি নৌপথ দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দেয়া সম্ভব। এছাড়া ট্রানজিট সুবিধা দিতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা (৭০০ কোটি ডলার) বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। তবে এতে পরিবহন বাবদ ১৫ ধরনের মাশুল আদায় করা যাবে। কোর কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে প্রক্রিয়া শুরু করার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেয়া সম্ভব নয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ট্রানশিপমেন্ট দেয়া যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে ট্রানশিপমেন্টের পরিধি বাড়ানো ও অবকাঠামো উন্নয়ন করে পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিটে যাওয়া সম্ভব।
×