ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টেন্ডারবাজির উপশমে

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৯ জুন ২০১৫

টেন্ডারবাজির উপশমে

দরপত্র শব্দটা কখন যে ইংরেজী প্রতিরূপ টেন্ডারে পরিণত হয়ে ক্রমশ দেশবাসীর কাছে টেন্ডারবাজিতে পরিণত হয়ে গেছে, তার হদিস মেলে। চার দশকের পুরনো এই ‘বাজির’ বিকাশ পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসনামলে। দেশবাসী তখন পারমিট, লাইসেন্স প্রভৃতি শব্দের পাশাপাশি টেন্ডার এবং টেন্ডারবাজি শব্দ দুটির সঙ্গেও পরিচিত হয়ে ওঠে। নির্বাচিত সরকার আমলে ১৯৯১ সাল হতে টেন্ডারবাজির দৌরাত্ম্য বাড়ে এবং এর বিস্তার ঘটে অস্ত্রের ঝনঝনানি, খুন, জখমের সিকোয়েন্সে। টেন্ডারবাজি এক ধরনের অসুখ। যে অসুখ থাকে লুটেরা সন্ত্রাসীদের। এই অসুখের উপশমের পথ টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। পাশাপাশি অনলাইনে সব টেন্ডার জমা দেয়ার পদ্ধতি চালু করলে সংঘর্ষ, হানাহানি, অস্ত্রবাজি, অফিস ভাংচুর, ত্রাসের রাজত্ব বন্ধ হবে। সরকার অবশ্য বহুবার বলে এসেছে অনলাইনে দরপত্র চালু করার কথা। কিন্তু মাত্র কয়েকটি দফতর এই পন্থা অবলম্বন করলেও অধিকাংশই এর আওতায় আসেনি। টেন্ডারের নামে পেশীশক্তির প্রদর্শন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে। সরকার বদলায় কিন্তু টেন্ডারবাজি আর বন্ধ হয় না। সংঘর্ষ আর দলীয়করণের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে ইলেক্ট্রনিক টেন্ডারিং বা ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থার চালুর নির্দেশ থাকলেও তা সর্বত্র রূপ পায়নি। ই-মেইলের মাধ্যমে দরপত্র দাখিল করার পদক্ষেপও নেয়া হয়। দেশে তো বটেই বিদেশ থেকেও কেউ ইচ্ছে করলে দরপত্রে অংশ নিতে পারার কথা রয়েছে তাতে। যদিও তার কোন নমুনা দেখা যায়নি। আশা করা হয়েছিল, ই-টেন্ডার চালু হওয়ায় দরপত্র দাখিলের নামে পেশীশক্তির প্রদর্শন বন্ধ হবে। প্রতিযোগীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দরপত্র থেকে দূরে রাখার প্রক্রিয়ায় বাদ সাধবে ই-টেন্ডার পদ্ধতি। দরপত্রে অংশ নিতে ইচ্ছুক সব দরপত্রদাতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে প্রতিটি সরকারী কাজ প্রতিযোগিতামূলক দামে করা সম্ভব হবে। ধারণা করা হয়েছিল এর ফলে দরপত্রে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্যাডার ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের যে দাপট রয়েছে তার অবসান হবে। সরকারী দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে সরকারী কাজ বাগিয়ে নেয়ার সুযোগও বন্ধ হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং শনৈঃ শনৈঃ এসবের দাপট বেড়েছে। জনগণ দেখে এসেছে জান্তা শাসক জিয়া, এরশাদ ও পরবর্তীকালে নির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে টেন্ডারবাজিই হয়ে পড়ে ছাত্র ও যুব নেতাকর্মীদের প্রধান কাজ। দল ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমর্থিত বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। টেন্ডারবাজদের অপতৎপরতা ও সহিংস আচরণের খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রায়শই। সরকারের সব উন্নয়ন কর্মকা- তছনছ করে দিতে টেন্ডারবাজরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখে আসছে। টেন্ডারবাজদের কোন দল থাকতে পারে না। দলীয় নেতাকর্মীরা যেহেতু জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, সরকারের কর্মকা-কে গতিশীল করেন, সেহেতু তারা টেন্ডারবাজি করবেন কেন? যারা করে তাদের প্রধান পরিচয় তারা দেশ ও জাতির শত্রু। টেন্ডারবাজদের দমন করতে হলে সহযোগী সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সঙ্গত। আর এমনটাই করতে চাচ্ছেন, ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। টেন্ডারবাজদের মস্তানি ছেড়ে দিয়ে সিটি কর্পোরেশনে আসার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেছেন, নতুবা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। নিজেই ব্যবস্থা নেবেনÑ এমন সাহসী উচ্চারণ আশাবাদ জাগায়। মাস্তানী করে কেউ কোন উন্নয়ন কাজ পাবে না বলে তিনি যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা সর্বত্র কার্যকর হলে দেশ টেন্ডারবাজির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। সরকার ও প্রশাসনকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, সরকারের সুনাম রক্ষার স্বার্থে এবং সন্ত্রাস বন্ধে।
×