ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবার পেট্রোলবোমা, কানেকটিভিটি যুক্তরাষ্ট্রে মিটিং!

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৯ জুন ২০১৫

আবার পেট্রোলবোমা, কানেকটিভিটি যুক্তরাষ্ট্রে মিটিং!

বাঙালী যে অতি দ্রুত অকল্পনীয় কষ্ট-যন্ত্রণাও ভুলে যায়, তা আরও একবার প্রমাণিত হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামায়াত অধ্যুষিত চান্দিনার কাছে শব-ই-বরাতের পবিত্র রাতে ধর্মকে খুনের হাতিয়ার করা জামায়াত-শিবির গোষ্ঠী দ্বারা চলন্ত বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এ ঘটনায় বাঙালী নতুন করে স্তম্ভিত হলো। সারাদেশের মানুষ ভুলে যাওয়া, মাত্র দুই মাস আগে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে গণপরিবহনের ওপর খালেদা-তারেকের নির্দেশে পরিচালিত বর্বর-অমানুষিক সেই পেট্রোলবোমায় দগ্ধ, মৃত্যুমুখে পড়া নিরীহ নারী-পুুরুষ, কিশোর, শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের কথা ঘৃণার সঙ্গে স্মরণ করল। অথচ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে, দেশের অন্য জেলা, হাসপাতালগুলোতে যে এখনও খালেদা নির্দেশিত পেট্রোলবোমা হামলায় দগ্ধ রোগীর সেবা গ্রহণ করছে পুরোপুরি সুস্থ হতে; তা এ দু’মাসে রোগীর স্বজন ছাড়া আমরা অন্যরা সবাই বিস্মৃত হয়েছিলাম। কেন আমরা জনগণ, ঐ তিন মাসে সংঘটিত খালেদা নির্দেশিত, বিএনপি, জামায়াতের ক্যাডারকৃত বর্বর মানবতার বিরুদ্ধে ঐ অপরাধের বিচার দ্রুত শুরু করার জন্য দাবিকে আরও জোরদার করিনি? ঐ তিন মাসজুড়ে যা চলেছিল, তা তো পরিকল্পিত গণহত্যা, তা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ঠা-া মাথায় পরিকল্পনা করে রাজনৈতিক অফিসকে দামী আসবাব-তৈজসপত্র দিয়ে ধনীর বিলাসী বাসগৃহে পরিণত করে খালেদা যেখানে বাস করে তিন মাস যাবত এ বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করেছে, এ কথা যেন বাঙালী ভুলেই গিয়েছিল। বিশেষত যখন মেয়র নির্বাচনে এ গণত্যাকারীদের প্রার্থীকে গণহত্যার শিকার ও ঐ গণহত্যার প্রত্যাখ্যানকারী জনগণ দেখেছে লক্ষ ভোট লাভ করতে, তখনও স্তম্ভিত হয়েছিল জনগণ। এখনও সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রতি বিশ্বাসী মানুষ অসুস্থ ধারার অপরাজনীতিকে তাদের সদ্য শেষ করা গণহত্যার পরও জনমানুষের মধ্যে এত সমর্থন দেখে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। কেননা এদের হাতে ’৭১-এ, ’৭৫-এ, ২০১৩ তে, ২০১৫ তে ধর্মের নাম ব্যবহার করে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালী সংস্কৃতি ও শেষ পর্যন্ত কিভাবে গণতন্ত্রকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’র নামে টুঁটি চেপে ধরে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার ব্রত নিয়ে গণহত্যায় নেমেছিল! এ বোমাহামলা যেন সে শঙ্কাকে আরও বড় করে তুলেছে। যাই হোক, বিগত শব-ই-বরাতের রাতে কেন রাজনীতির নামে ধর্মকে ব্যবহারকারী জামায়াত-শিবির ধর্মকে, আল্লাহ, রসূলকে চরম অসম্মানিত করে মধ্যরাতে ঘুমন্ত ও নামাজরত বাসযাত্রীদের ওপর পেট্রালবোমা নিক্ষেপ করার মতো বর্বর পাপ বা গুনাহ্র কাজটি করতে পিছপা হলো নাÑ অবশ্যই এর পেছনে গভীর কোন উদ্দেশ্য আছে। তার আগে জানতে চাই, দেশের প্রকৃত ধার্মিক, ধর্মতত্ত্ববিদরা এই শব-ই-বরাতের রাতে, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকারীদের ‘কাফের’ ‘মুরতাদ’ ‘অ-মুসলিম’ আখ্যা দেবেন কি না! এটি দেখার অপেক্ষায় আছে লাখ লাখ প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী। এখন মূল কথায় ফিরে আসি। আকস্মিকভাবে, এপ্রিল-মে মাত্র দু’মাস পর জামায়াত-বিএনপি জোটের কেন আবার রাজপথের পরিবহনের ওপর দ্বিতীয়বার পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনা সংঘটন করতে পবিত্র শব-ই-বরাতের রাতকে পর্যন্ত উপেক্ষা করতে হলো? কারণ খুঁজতে অবশ্য খুব দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। প্রথমত, ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির ক্ষীয়মাণ অবশিষ্ট দল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর সফরের পূর্ব মুহূর্তে একটি বার্তা দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে, বার্তাটি হচ্ছে- ‘আমরা এখনও আছি’। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের বাংলাদেশ সফরের প্রধান একটি এজেন্ডা হলো ভারত-বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালের মধ্যে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চুক্তির সূচনা করা এবং এরই মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ পরিবহন কলকাতা-ঢাকা হয়ে ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয় পর্যন্ত স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হতে চলেছে, যার মাধ্যমে যাত্রী ও পণ্য অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাণিজ্য-বাজার উত্তর ও পূর্ব ভারতে উন্মুক্ত হতে চলেছে। উপরন্তু বর্তমানে সমুদ্রের উপকূল ধরে ভারত থেকে পণ্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্য বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে দ্রুত ও কম খরচে পৌঁছাতে পারবে, যার জন্য বাংলাদেশ বন্দর ব্যবহারের জন্য শুল্ক আয় করবে। এই যোগাযোগ রুট শীঘ্রই ব্যবহার করবে ভুটান ও নেপাল, যেখানে বাংলাদেশী পণ্যের বাজারের সম্প্রসারণ ঘটবে। এই যোগাযোগের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, নানারকম ইতিবাচক সুফল পরোক্ষভাবে সব দেশই ভোগ করবে। সাংস্কৃতিক, ভাষাগত আদান-প্রদান অবধারিতভাবে অনেক বেশি হবে। ফলে বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতির ওপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারকারী দেশ ও জাতি এবং তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর জীবন-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ম ও জীবিকা পরিবর্তনের চাপে পড়বে এবং পরিবর্তিত হবে, অন্তত আজকের অবস্থান তাদেরকে বদলাতেই হবে। এর আরেকটি অবশ্যম্ভাবী ফল- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা রাখবে। এখন সহজ একটি প্রশ্ন উঠবে- যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্র চায়নি, বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা চায়নি, যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের নতজানু দেশ হিসেবে রাখতে তৎপর, সর্বোপরি যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ-ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ ধ্বংসে সক্রিয় তারা শুধু যে আমাদের তরুণ বিজ্ঞান ও যুক্তি চর্চাকারীদের তালিকা করে হত্যার মধ্যে তাদের দেশ ধ্বংসের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখবে, তা নয়। তারা তাদের সীমাবদ্ধ ধর্ম-জ্ঞান ও তাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অন্ধ-বিশ্বাসী নেতাদের ভ্রান্ত নির্দেশে ঠিক ’৭১-এর মতোই বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যার তালিকা করে প্রমাণ করেছে তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা শুধু যে যুগের জন্য অচল, তা নয়। তারা ’৭১-এর প্রাচীন, অচল ভ্রান্ত শিক্ষাকে এখন, এই ২০১৫ তেও প্রত্যাখ্যান করার মতো আধুনিক জ্ঞান ও শিক্ষা অর্জন করেনি। কি আশ্চর্য, তারা ’৭১- থেকে এক পাও সামনে এগোতে পারেনি। ’৭১-এই বন্দী হয়ে আছে তাদের মেধা, বুদ্ধি, কর্মতৎপরতা, যা তাদেরকে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানও মুক্তি দিতে পারেনি। আমরা যারা শিক্ষকতা করেছি, তাদের মনে আজ এই প্রশ্ন জাগছে যে, ইসলাম ধর্মের নামটি ব্যবহার করে নতুন, তরুণ প্রজন্মের ধর্মতত্ত্ববিদ কি জন্ম নিয়ে ঐ আলবদর, আলশাম্স, জেএমবি, জামায়াত, হরকত-উল-জিহাদ, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ইত্যাদি অন্ধ, অ-ইসলামী মৌলবাদকে প্রত্যাখ্যান করবে না এবং উক্ত দলগুলোকে ‘ধর্মের অবমাননাকারী’ ঘোষণা করবে না? নতুন প্রজন্মের ধর্মতত্ত্ববিদ কি শিয়া, সুন্নি, কুর্দি ইত্যাদি সেক্টরের মধ্যে কাটাকাটি মারামারিকে মোহাম্মদের (স.), আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত ঘোষণা করবে না? সর্বোপরি তারা কি স্বদেশের উন্নয়নবিরোধীদের স্বজাতির ওপর যুক্তিহীন হামলাকে ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেবে না? যারা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে তাদেরকে গুনাহগার, দেশের ও জাতির শত্রু“গণ্য করবে না? তাদের জন্ম কি কখনোই হবে না? তাছাড়া খালেদা-তারেক বহুবার প্রমাণ দিয়েছে, তারা বাংলাদেশ স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরোধী; যেখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, আদিবাসী একত্রে মিলেমিশে উন্নত নিরাপদ জীবন যাপন করবে। এ কারণে তারা বারংবার বাংলাদেশকে অনুন্নত, অনিরাপদ, জঙ্গীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করতে সচেষ্ট। তাছাড়া তাদেরকে নেপথ্যে থেকে আইএসআই বাংলাদেশের উন্নয়নে অব্যাহত অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নানামুখী চেষ্টা চালিয়েছে, ভবিষ্যতেও চালাবার চেষ্টা করবে। কেননা ’৭১-এর খুনী হিসেবে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত জামায়াত একমাত্র বিএনপির ছত্রছায়ায় থেকে বাংলাদেশের বিরোধী অপতৎপরতা চালাতে পারছে। সেজন্য খালেদা-তারেকের বিএনপি আজ আইএসআই-এর অন্ধের যষ্টি! এরই পাশে যেখানে আজ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভেঙ্গে পড়ছে, তুমুল লড়াইয়ে প্রতিদিন যেখানে শত শত বেসামরিক, নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যু হচ্ছে সেখানে যুদ্ধ বন্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ না নিয়ে, বরং যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার মধ্যেও আপাতত শান্ত, দ্রুত উন্নয়নশীল ‘বাংলাদেশের রাজনীতি’ নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের পূর্বে দ্রুত এক সভা-সেমিনার করেছে। গত ২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব সাউথ এ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান এ্যাফেয়ার্সের ডেপুটি এ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি বাংলাদেশের বর্তমানের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচক শাসনের প্রবণতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, বর্তমানে রাজনৈতিক পরিবেশে যে অচলাবস্থা তাতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিচের দিকে নেমে যাবে। সে কারণে বাংলাদেশকে এই অবনমনের হাত থেকে রক্ষা করতে তারা নাকি এখন এই আবদ্ধ অবস্থার দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের ওপর জোর দেবে, যাতে সে সমাধানে সব দলের (অবশ্যই অনুক্ত বিএনপি-জামায়াত, যারা পেট্রোলবোমা মেরেও এদের কাছে প্রিয়জন!) জন্য কাজ করবে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ অবাধে ও শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অধিকার অনুশীলন করতে সক্ষম হয়। এর সঙ্গে অবশ্য তিনি বাংলাদেশের উন্নত দেশ হবার সক্ষমতার কথাও উল্লেখ করেন, যা না করলে শ্বেতাঙ্গজনোচিত ভদ্র আচরণ হয় না। যাইহোক, এই সভার বক্তব্য আসলে বর্তমান স্থিতিশীলতাকে দায়ী করে পরোক্ষভাবে খালেদা-জামায়াতকে বাংলাদেশ-ভারতসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার চিরাচরিত পাশ্চাত্যনীতি বলেই বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রতীয়মান। কে না জানে, সার্ক বা ভারত-বাংলাদেশ-চীন বা দঃ এশিয়া ঐক্যবদ্ধ হোক, তা প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যের কাছে কাক্সিক্ষত নয়। খালেদা যদি আবার ভারত-বাংলাদেশ যোগাযোগের নতুন ব্যবস্থার ওপর আঘাত হানতে চেষ্টা করে, তাহলে তার পেছনে কারা বুদ্ধিদাতা, তা অবশ্য প্রকাশ হয়ে যাবে। এখানে বিএনপির প্রগতিশীল অংশের নেতা-নেত্রীদের দেশ ও জাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশসহ দঃ এশিয়াকে জঙ্গীমৌলবাদমুক্ত, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করতে এগিয়ে আসার সময়। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে, মহাকাল আকস্মিকভাবে এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন ঘটানোর একটি দুর্লভ সুযোগ এনে দিয়েছে, যা গ্রহণ করে বিএনপির প্রগতিশীল অংশ তাদের রাজনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন। এমন সুযোগ কিন্তু দু’বার আসে না। কালের যাত্রার ধ্বনি শুনুন, প্লিজ্। আর হুকুমদাস জীবন্মৃত হয়ে থাকবেন না। উঠুন, দেশ গঠনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির সঙ্গে যোগ দিন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×