ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এসএসসি ॥ শত বাধা পেরিয়ে

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৮ জুন ২০১৫

এসএসসি ॥ শত বাধা পেরিয়ে

অভাবের জ্বালা যে কতটা ভয়াবহ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পিতাহারা নুসরাত জাহান মিতু। শুধু টাকার অভাবে স্কুলে যেতে পারেনি মাসের পর মাস। মাত্র একটি স্কুল ড্রেসে কেটেগেছে দুই বছর। টিউশনি পড়ার সামর্থ হয়নি। উপোস করে স্কুলে আসা ছিল নিত্য ঘটনা। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করা ছিল খুব কষ্টের। আয় রোজগারের কেউ নেই। নেই আবাদী জমি। বাড়িতে বসে মা রাহেনা বেগম সেলাইয়ের কাজ করেন। সময় পেলেই মায়ের কাজে সহায়তা করে মিতু। এতসব প্রতিকূলতার মাঝেও মিতু চলতি এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে মায়ের কষ্ট সার্থক করেছে। কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ১২ কিমি. দূরে উলিপুর উপজেলার পাঁচপীর দুর্গাপুর এলাকার মৃত আজগর আলীর দ্বিতীয় কন্যা মিতু। ২০০৭ সালে সাপের কামড়ে কাঠমিস্ত্রি আজগর আলীর মারা যান। সে যন্ত্রণা মিতুকে এখনও তাড়া করে। সময় মতো কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও শুধু ভেকসিনের অভাবে ১২ ঘণ্টা পর বলা চলে বিনাচিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়। এ যন্ত্রণা লাঘবে গরিব অসহায় মানুষের সেবার প্রত্যয় নিয়ে মিতু স্বপ্ন দেখে চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণের প্রধান অন্তরায় দরিদ্রতা। ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মিতু দু’চোখে অন্ধকার দেখে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নয়। বড় বোন নাসিফা নাওয়াল ঢাকায় মিরপুর বাংলা কলেজে ইংরেজী বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সে টিউশনি পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়ে নিচ্ছে। আতিকুর রহমান কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঠাঁলবাড়ী ইউনিয়নের শিবরাম গ্রামে মামার বাড়িতে আশ্রিত থেকে মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে আতিকুর রহমান। সে কুড়িগ্রাম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। হলোখানা ইউনিয়নের সারডোব গ্রামের মৃত শাহাদত হোসেনের তিন সন্তানের মধ্যে আতিকুর দ্বিতীয়। মা স্বপ্না বেগম। এক সময় ছোট গৃহস্থ পরিবার ছিল। ১৫ বছর আগে ধরলা নদী সব স্বপ্ন ভেঙ্গে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় দুঃখের দিন। প্রায় ১১ বছর আগে শাহাদত হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু হয়। এরপর গোটা পরিবার পড়ে অথৈ সাগরে। অভাবের কারণে আতিকুর রহমানের আশ্রয় হয় কাঠাঁলবাড়ীর শিবরাম গ্রামের মামা রফিকুল ইসলামের বাড়িতে। প্রথম শ্রেণী থেকে সে এখানেই পড়ালেখা করে আসছে। অভাব অনটন ছিল সঙ্গী। পিতার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা বঞ্চিত এক জীবন। তখন থেকেই পণ করে আতিক ভাল কিছু করার। পুষ্টিকর খাবার, প্রয়োজনীয় পোশাক ছিল না। প্রাইভেট পড়তে পারেনি। সিনিয়র ছাত্রদের কাছ থেকে পড়া দেখিয়ে নিত। এত প্রতিকূল পরিবেশে ভাল ফল করতে পেরে সে খুশি। কিন্তু ভবিষ্যতের পড়ালেখা কিভাবে চলবে এ চিন্তা মাথায় এলে দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে আতিকের। তার স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে দুখি মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে। তাহমিনা আক্তার তুলি বাবা এনামুল হক ২০ বছর আগে বার্জার রোগে আক্রান্ত হয়। চার দফায় দুই পা কাটতে হয়। তার চিকিৎসা করতেই জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করতে হয়। এখন তার পঙ্গু জীবন। উলিপুর উপজেলার ধরণীবাড়ি গ্রামে তার নিবাস। মা রমিচা বেগম ও ছোট ভাই রাকিবুল হাসানকে নিয়ে কষ্টের জীবন। আয়-রোজগার করার কেউ নেই। আছে শুধু খরচ। আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় চলে সংসার ও লেখাপড়া। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। তাহমিনা আক্তার তুলি চলতি এসএসসি পরীক্ষায় উলিপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ধরণীবাড়ি গ্রামে চলছে আনন্দ উৎসব। কিন্তু আনন্দ নেই তুলির মনে। কারণ তার অজানা আশঙ্কা ভবিষ্যতের লেখাপড়া নিয়ে। পারিবারিক বিয়ের চাপকে উপেক্ষা করে সে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়। ভবিষ্যতে হতে চায় চিকিৎসক। তার এই স্বপ্ন পূরণের প্রধান বাধা অর্থনৈতিক দৈন্যতা। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বাবার অসুস্থতা এবং অক্ষমতা তার কষ্টের বড় কারণ। সুযোগ পেলে তুলি দরিদ্রতাকে জয় করে পরিবারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনবে। রহিমা বেগম দিনমজুর পরিবারের রহিমা বেগম দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে। উলিপুর উপজেলার চ-িজান এলাকার জানজায়গীর গ্রামে তার বাড়ি। মা আকলিমা বেগম ও ছোট ভাই কনক বাবুকে নিয়ে সংসার। অনাহার অর্ধাহার জীবনের সঙ্গী। বাড়ি থকে স্কুলের দুরত্ব প্রায় চার কিমি.। অর্থাভাবে হেঁটে যেতে হয়। অর্থাভাবে প্রাইভেট পড়া হয়নি তার। একটা কোচিং সেন্টারে বিনা পয়সায় পড়ত। তাই কোচিং ও স্কুল করতে সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বের হতে হতো। ফিরত ৫টায় স্কুল ছুটির পর। অধিকাংশ দিন সকালে খাবার জুটত না। বলা চলে অনাহারে দিন কাটত রহিমার। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের টাকায় ফরম ফিলাপ করে। এখনও পরিবারে ঋণ রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। এই টানাপোড়েন সংসারে সহায়তা করতে রহিমা দুইটি টিউশনি পড়াত। এসব দিয়ে কোন রকমে টেনে হিঁচড়ে এত দূর পথ চলা। এখন উচ্চশিক্ষা নিয়ে চিন্তিত রহিমা। সে প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ স্বপ্ন পূরণ কিভাবে হবে তা তার জানা নেই। এই দুঃখের জীবন বদলে সকলের সহযোগিতা চান রহিমা। লিপটি বেগম লিমা কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার আপুয়ার খাতা আমিনা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে লিপটি বেগম লিমা। সে চিকিৎসক হয়ে পরিবারের ভাগ্য বদলাতে চায়। পান্ডুল ইউনিয়নের আপুয়ার খাতা নুটাপাড়া গ্রামের দিনমজুর মজিউল ইসলামের ২ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে লিমা দ্বিতীয়। মা সাজেদা বেগম অভাবি সংসারের যাঁতাকলে পড়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। এ দু’জনের আয়ে কোন রকমে চলে সংসার। এর উপর পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন দিনমজুর পিতা মজিউল ইসলাম। অর্থাভাবে বড় ভাই তাজুলের পড়ালেখা হয়নি। ছোট বোন বিউটি পড়ে পঞ্চম শ্রেণীতে। পুষ্টিকর খাবার জোটে না দুই বেলা। নেই প্রয়োজনীয় পোশাক, বই, খাতা-কলম। টিউশনি পড়ার সুযোগ হয়নি। শুধু অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে বার বার লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়। এসএসসি পাস করার আনন্দও এখন ফিকে হয়ে গেছে। কারণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অর্থ সংস্থান নেই। মহিদেব নামে স্থানীয় একটি এনজিওর কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকায় এসএসসির ফরম পূরণ করে সে। এখন ভর্তি ও বই কেনার অর্থ সংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। নিত্যদিনের অনাহার অর্ধাহারকে জয় করে লিমা পড়ালেখা করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
×