ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছিটের মানুষ মহাখুশি, কাল একযোগে বিজয় মিছিল

চিরতরে ছিটমহলের বিদায়, অন্ধকার ভূখণ্ডে আশার আলো

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৮ জুন ২০১৫

চিরতরে ছিটমহলের বিদায়, অন্ধকার ভূখণ্ডে আশার আলো

সমুদ্র হক ॥ প্রায় ছয় যুগ পর ‘ছিটমহল’ শব্দটি চিরতরে বিদায় নিল। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের পেটের ভেতর থাকা ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে দুই দেশের মানুষের প্রতিকূলতা ও ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে পারাপার হওয়ার দিন ফুরাল। একদার ছিটমহল বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের ভূখণ্ডের মানুষ তো মহাখুশি। শনিবার বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের (শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি) মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর লালমনিরহাট, পঞ্চগড় কুড়িগ্রাম নীলফামারীর ছিটমহলের (এখন আর ছিটমহল নয়) মানুষের মধ্যে যে উল্লাস দেখা যায় তা গত ৬৮ বছরেও দেখা যায়নি, এমন মন্তব্য স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের। কুড়িগ্রামের ছিটমহল সমন্বয়কারীর সভাপতি মইনুল হোসেন জানালেন, বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ১শ’ ১১ ভূখণ্ডে যা বিনিময় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের অংশ সেখানে আগামীকাল (৯ জুন ২০১৫) একযোগে বিজয় মিছিল হবে। একইভাবে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১ ভূখণ্ডেও বিজয় মিছিল হবে। উল্লেখ্য, এই বিনিময় চুক্তিতে ভারতীয় ভূখ-ের ১৭ হাজার ১শ’ ৬০ একর বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে গেল। আর বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ৭ হাজার ১শ’ ১০ একর ভারতীয় ভূখ- হলো। এ ভূখণ্ডের মানুষরা জমি জিরাতসহ যে যার অবস্থানে ছিল সেখানেই রয়ে গেল। একদা ভারতের ছিটমহল বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব মানুষের মধ্যে একটাই কথা, চোখের সামনে সব কিছু থাকলেও আমাদের যেতে হয়েছে ভারতে। স্কুল-কলেজ হাসপাতাল হাটবাজার থানা পুলিশ সবই ছিল চোখের সামনে, এক পা বাড়ালেই মিলত সহযোগিতা। যুগের পর যুগ ধরে সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে। একইভাবে ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ ভূখ-ের মানুষকে একই যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। চোখের সামনেই দেশ তবু আইনগতভাবে চলাচল ছিল বারণ। এক দেশের নাগরিক হয়ে আরেক দেশে গিয়ে চিকিৎসা হাটবাজার প্রজন্মের লেখাপড়া করাতে হয়েছে। কত বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে। এখন সবকিছুই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পুটিমারী এলাকার ছিটমহল বিনিময়ের আহ্বায়ক ময়দানদীঘি উপজেলার চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার বললেন, এখন কেউ আর নিজ ভূমে পরবাসী নয়। পাখিদের যেমন ভাসা আছে, ঘোড়ার যেমন আছে আস্তাবল, একদা ছিটমহলের মানুষ পেল নিজ ভূখ-। এ যেন স্বাধীনতার মতোই স্বাদ। ১৯৪৭ সালে র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদ যে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তা এখন অপসারিত। এজন্য যুগের পর যুগ ধরে কত আন্দোলন করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে যে চুক্তি হয়ে টানেলে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল তা নিভে যায় ৭৫-এর পটপরিবর্তনে। নিভে যাওয়া এই প্রদীপের সলতেয় দুই ভূখ-ের হতাশ হয়ে পড়া মানুষের মধ্যে আশার হৃদয় নিংড়ানো দীপ জ্বালিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চিরদিনের জন্য এই দীপ জ্বলে রইল। ছিট ভূখ-ে এতদিন যাদের পরিচয় ছিল ভারতীয় তারা হয়ে গেলেন বাংলাদেশী যাদের পরিচয় ছিল বাংলাদেশী তারা হয়ে গেলেন ভারতীয়। এই সময়টায় বাংলাদেশ ভারতের এমন মিলনবন্ধন যারা দেখছেন আনন্দে তারা অশ্রুর স্র্রোতরেখা ধরে রাখতে পারছে না। এমনই একজন ভারতের কোচবিহারের দীনহাটার বিধায়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ ছিটমহল কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক। বললেন, বংশপরম্পরায় তারা ছিটমহল বিনিময় নিয়ে আন্দোলন করছেন। তার বাবা দীপক সেনগুপ্ত (প্রয়াত) ছিলেন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আন্দোলনের অন্যতম সদস্য। দীপক সেনগুপ্তের পরলোকের পর ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত হাল ধরেন। বিনিময় চুক্তির আগে যে সমন্বয় কমিটি হয়েছিল তার সভাপতি মইনুল হক ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, এখন থেকে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময়ের পর ভূখ-ের যার যা স্থাবর অস্থাবর সম্পদ তারই থাকবে। মালিকানায় থাকবে সরকার। ছিটমহল আন্দোলনকারীর কোচবিহারের ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা যিনি ভারতীয় ছিটে অবস্থান করছিলেন তিনি বাংলাদেশের হয়ে গেছেন। এমন অনেক নেতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাস করবেন। এ বিষয়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ের অদিবাসী চিন্ময় সেন বললেন, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এখন আমরা আবদ্ধ। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, বিনিময় চুক্তি হওয়ার সঙ্গেই জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ওই এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। মাইকিং করা হচ্ছে এখন থেকে সকল সুযোগ-সুবিধার জন্য বাংলাদেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখন আর কোন ভীতি রইল না। সকল ভীতির উর্ধে উঠে নিজের দেশে বাস করবে তারা। এদিকে প্রত্যেক ছিটমহলে (বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখ-) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটি গঠিত হয়েছে। যার সদস্য সংখ্যা নিচে ৩১ জন সর্বোচ্চ ৭১ জন। তারা প্রতিটি এলাকায় শান্তি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। এসব কমিটির প্রধান আহ্বায়ক এবং কমিটির উপদেষ্টা উপজেলা নির্বাহী অফিসার। দেবীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান হাসনাত জামান চৌধুরী বললেন, শালবাড়ি বেহুলারধারা বালাপাড়া কাজলদীঘি যে এলাকাগুলো ছিল ভারতীয় ছিট সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে কয়েক দফা মিটিং করে উন্নয়ন কাজের ফিরিস্তি দিয়েছেন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্ব^াস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল স্থানীয় সরকার প্রশাসনের সব কাঠামো আগেভাগেই তৈরি করা হয়েছে। যাতে ঘোষণা দেয়ার সঙ্গেই কাজ শুরু করা যায়। ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন ও পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানালেন, শনিবার সন্ধ্যার পরই ওই এলাকার স্থানীয় শাসনভার বুঝিয়ে নেয়া হয়েছে। লোকজনকে আশ্বস্ত করা হয়েছে তারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। প্রশাসনের সকল কাজেই তারা বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী সহযোগিতা পাবে। তাদের ছেলেমেয়রা যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলও এখন বাংলাদেশের কোন ধরনের অসুবিধা হবে না। এলাকার মানুষও এখন মহাখুশি। সবচেয়ে মজার বিষয় ঘটেছে কুড়িগ্রামের বড় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ায় বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখ-। এখনই তারা দাবি তুলেছে ইউনিয়ন ঘোষণার। কয়েকজন কৌতূহলী হয়ে স্কুলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। এরা এতটাই খুশি যে এলাকায় উন্নয়নের জন্য সরকার যে বরাদ্দ দিয়েছে তাও তারা জানতে পেরেছে। কয়েকজন জেলা প্রশাসনের কাছে ধর্না দিয়ে বলেছে এলাকার উন্নয়ন যেন আগে করা হয়। তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মিছিল করেছে। দিন কয়েক আগেই যারা ফুলবাড়ি ভুরুঙ্গামারী উপজেলা সদরে সরাসরি যেতে পারত না তারা এখন মনের আনন্দে কেউ ঠেলাগাড়ি কেউ শ্যালোচালিত যানবাহনে আনন্দ উল্লাস করে পথে নেমেছে। এদিকে নীলফামারীর জিগাবাড়ি এলাকার জয়নাল আবেদীন আবেগের সঙ্গে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশের নাগরিক হয়েই মরতে পারব।’ ডিমলা উপজেলার বড়খারিজা গীতালদহ তালুকখারিজা এলাকার মানুষের মধ্যে বইছে আনন্দের ঢেউ। নূর হোসেন মোজাম্মেল হোসেন যদুনাথ চন্দ্র বললেন কোন দেশই তাদের মানুষ বলে গণ্য করেনি। জন্ম মৃত্যুর কোন সরকারী হিসাব ছিল না। ইতোমধ্যে নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে একদার ছিটমহল এখন বাংলাদেশ ভূখ- পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানালেন সরকারী বিধি মোতাবেক এখন সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে। যে এলাকাগুলোতে এখনও আইনশৃঙ্খলা কমিটি গঠিত হয়নি সেখানে দ্রুত তা গঠন করা হবে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহীন জানালেন, এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নজরদারিতে রয়েছে। দেশের যে চারটি জেলার মধ্যে ভারতের ১শ’ ১১ ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখ- হয়ে গেল তার সকল উন্নয়ন কর্মকা- শীঘ্রই শুরু হবে। এমনটি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকগণ। লালমনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, জেলার ভেতরে থাকা নতুন বাংলাদেশ (ছিটমহল) ভূখ-ের জন্য ৫০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ জরিপ কাজ শেষ করে কোথায় কোন অবকাঠামো জরুরী ভিত্তিতে দরকার তা নির্ধারণ করেছেন।
×