ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পানি বণ্টনে অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৮ জুন ২০১৫

পানি বণ্টনে অঙ্গীকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের মাধ্যদিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন সব নদীর পানি বণ্টনে অঙ্গীকার প্রদান করছে। সেই সঙ্গে ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি করা হবে। একই সঙ্গে ভারত অঙ্গীকার করেছে, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারত গ্রহণ করবে না। শুধু তাই নয়, বর্তমান ফর্মে টিপাইমুখ জলবিদ্যুত প্রকল্পও বাস্তবায়ন করবে না। ‘নতুন প্রজন্ম- নয়া দিশা’ শীর্ষক এক যৌথ ইশতেহারে এসব অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, উভয় দেশ উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে কোন দেশ কারও সীমানায় কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রশ্রয় দেবে না বলেও অঙ্গীকার করেছেন। সেই সঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইস্যুতে এক দেশ অপরকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে তথ্য আদান প্রদানে সম্মত হয়েছে। রবিবার বিকালে হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ৬৫ দফা যৌথ ইশতেহার পাঠ করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বলে মন্তব্য করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও বেগবান করবে। যৌথ ইশতেহারে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময় হয়েছে। এছাড়া তিন নেতার উপস্থিতিতে বাস সেবার উদ্বোধন হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সমর্থন আদায়ে ভূমিকার কথা স্মরণ করে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দিয়েছে বাংলাদেশ। বাজপেয়ীর পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সম্মাননা গ্রহণ করেছেন। ইশতেহারে বলা হয়, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে উভয় প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যকার ইতিহাস, ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করেন। এ সময় দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেন উভয় দেশের মধ্যে শান্তি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার অপূর্ব মিল রয়েছে। এ সময় তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন এক যুগে প্রবেশ করল। যৌথ ইশতেহারে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ পরামর্শ কমিশনের বৈঠক (জেসিসি) চলতি বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। এতে আরও বলা হয়, উভয় প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় তারা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইস্যুতে এক দেশ অপর দেশকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে তথ্য আদান-প্রদানে সম্মত হন। তারা কোন দেশ কারও সীমানায় কোন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রশ্রয় দেবে না। এ সময় নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি উভয় প্রধানমন্ত্রী জাল টাকা পাচার প্রতিরোধ, মানবপাচার প্রতিরোধ ও নৌবাহিনীর কোস্টগার্ড পর্যায়ে সহযোগিতায় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকে সন্তোষ প্রকাশ করেন। যৌথ ইশতেহারে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের কাছে সহযোগিতা চান। এ সময় মোদি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, তাদের দেশের সংস্থা বাংলাদেশের এই প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। যৌথ ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সফরকালে তিস্তা পানি বণ্টনের বিষয়ে যে সম্মত হয়েছিল তার দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি করা হবে। এ সময় উভয় প্রধানমন্ত্রী মনু, মহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে আলোচনা করেন। আগামীতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে এসব নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য কর্মকর্তাদের তারা নির্দেশ দেন। এ সময় দুই দেশ যৌথ নদী কমিশনের ৩৮তম বৈঠক দ্রুত সময়ে অনুষ্ঠানের তাগিদ দেন। যৌথ ইশতেহারে ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত উন্নয়ন সহযোগিতা কাঠামো চুক্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়, দুই দেশ অভিন্ন সব নদীর পানি বণ্টন ও পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে অঙ্গীকার প্রদান করছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেন বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি করে এমন কোন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারত গ্রহণ করবে না। শুধু তাই নয়, বর্তমানে যে অবস্থায় টিপাইমুখ জলবিদ্যুত প্রকল্প বিদ্যমান রয়েছে তা বাস্তবায়ন করবে না। বাংলাদেশের ক্ষতি করে ভারত এ বিষয়ে একক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। উভয় দেশ বিদ্যুতখাতে সহযোগিতা ও অর্জনের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এই সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত হয়। বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপালের মধ্যে আন্তঃদেশীয় বিদ্যুত গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুত আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্য প্রতিবছর বাংলাদেশ-ভারত এনার্জি ডায়ালগ অনুষ্ঠানের গুরুত্বারোপ করা হয়। এই সহযোগিতায় কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, এলএনজি, পেট্রোলিয়াম পণ্য, নবায়ন যোগ্য জ্বালানি, তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সংবাদ সম্মেলন ॥ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর রবিবার বিকেলে সোনারগাঁও হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও বেগবান করবে। এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, খুলনা-কলকাতা রুটে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু বিষয়ে এর সম্ভাব্যতা যাছাই চলছে। আশা করি অচিরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশসহ নেপাল-ভুটান ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর বিদ্যুত ব্যবস্থা উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করছি। কেননা উন্নয়নের জন্য বিদ্যুত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভেড়ামারা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত বিদ্যুত সম্প্রসারণ লাইনের কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করেন এস জয়শঙ্কর। মোদির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক নিয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা অবশ্যই গণতন্ত্রের পক্ষে। তবে একই সঙ্গে জঙ্গীবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরোধিতা করি। ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেন্যদের সম্মাননা দিয়ে বাংলাদেশ আমাদের গর্বিত করেছে। এতে আমাদের সম্পর্ক আরও সুদূঢ় হবে,’ যোগ করেন তিনি। এ সময় সফররত ভারত সরকারের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ, ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ, ফার্স্ট সেক্রেটারি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শনিবার দুই দিনের জন্য ঢাকা সফরে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথম দিনে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এছাড়া দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের পক্ষের নেতৃত্ব দেন তিনি। রবিবার সফরের দ্বিতীয় দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রামকৃষ্ণ মিশন ও ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেন। এছাড়া তিনি ভারতীয় দূতাবাসের চ্যান্সারি ভবনে ছয়টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। এছাড়া বঙ্গভবনে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেয়া ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ গ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদি। সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া ঢাকা ত্যাগের আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক ‘জন বক্তৃতা’ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
×