ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

রাজনৈতিক অর্থনীতির দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে ঘোষিত বাজেটে

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ৮ জুন ২০১৫

রাজনৈতিক অর্থনীতির দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে ঘোষিত বাজেটে

আগামী অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বাজেটের মোট আকার দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বাজেটে দেখা যাচ্ছে মোট আয় ধরা হয়েছে দুই লাখ আট হাজার ১৪৩ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য একটি সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক অর্থনীতির দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছে ঘোষিত বাজেটে। তার অর্থনীতির দর্শন হচ্ছে, পেটে-ভাতে রাজনীতির অর্থনীতি। লিঙ্গ বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবদরদী এবং ব্যবসা ও কৃষিবান্ধব বাজেট হিসেবে এটিকে অবহিত করা যায়। বাজেটে যদি ঘাটতি কম থাকত তাহলে ভাল হতো। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হচ্ছে এমন কিছু দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা যারা বর্তমান সরকারের ছদ্মবেশী সমর্থক না হয়ে সত্যিকার অর্থে সরকারের সমর্থক হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে জননেত্রী শেখ হাসিনার আদর্শ বাস্তবায়নে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে। নিজেদের ইচ্ছে পূরণের চেয়ে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক মতাদর্শ যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনকল্যাণের দিকে ধাবিত করবে। বাজেট ঠিকমতো কাজ করছে, লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, নারী-পুরুষ সমতাভিত্তিক উন্নয়ন হচ্ছে, দারিদ্র্যমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে মানুষ। সেজন্যই দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা থাকবে এই বাজেটটি পহেলা জুলাই থেকে যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। পাশাপাশি সাপ্লিমেন্টারি রেগুলেটরি অর্ডারের (এসআরও) মাধ্যমে নতুন নতুন নীতিমালা ঘোষিত না হয়, সম্পূরক বাজেটের সঙ্গে মূল বাজেটে খুব বেশি পার্থক্য না থাকে এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাজেট পর্যালোচনা করে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ রাখব। জাতীয় রাজস্ব থেকে আয় ধরা হয়েছে ৫৯.৮ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ থেকে আয় ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। বৈদেশিক ঋণ আমরা যথাযথভাবে পাব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। বৈদেশিক অনুদান থেকে ধরা হয়েছে ২ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদান কতটুকু পাব তা নির্ভর করে আমাদের কতটুকু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। কিংবা এমন খাতে অনুদান আসবে যেগুলো খুব বেশি আমাদের দেশে কল্যাণকর কোন প্রকল্প নয়। কারণ বিশ্বজুড়েই যেসব দাতাগোষ্ঠী অনুদান দিয়ে থাকে তারা সব সময় নিজেদের দেশের স্বার্থসংরক্ষণ করে থাকে। অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন থেকে ধরা হয়েছে ১৯.১ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ২ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব থেকে যে আহরণ ধরা হয়েছে এটি আমার মনে হয় যথাযথ, তবে এ ক্ষেত্রে তিনটি ফ্যাক্টর কাজ করবে। একটি হচ্ছেÑ যারা করদাতা আছেন বা করের আওতায় আসবেন তাদের ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে কর দিতে ইচ্ছুক হতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ রাজস্ব বোর্ডের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন ঘুষ, দুর্নীতি দূর করতে হবে। তৃতীয়টি হচ্ছেÑ যারা করদাতা তারা যেন যথাযথ সেবা পান। করের বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছেন সেটা যেন অনুধাবন করতে পারেন। বিদেশের মতো করদাতারা যে ধরনের সেবা পান ওই ধরনের সেবার দিকে এগোতে হবে। বাজেটে সরকারের চাকরিজীবীদের বিভিন্ন ধরনের ভাতার ওপর করারোপের যে প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে সেটি যথাযথ হয়েছে। প্রতিবন্ধী ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে কর রেয়াতের যে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে সেটিও যথাযথ। তবে নারী ও ৬৫ বছরের উর্ধে কর্মক্ষম ব্যক্তির ওপর কর রেয়াত যথাযথ নয়। কেননা, তারা যদি সঠিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক পরিবেশে ব্যবসা করেন তবে এদেশে সুষ্ঠু বিনিয়োগ বাড়বে এবং অন্যরাও কর দিতে উৎসাহিত হবেন। যেখানে আমাদের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গেছে, সেখানে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে চিন্তা করে দেখা উচিত। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর হ্রাস করার প্রস্তাবনা রয়েছে, এটির কোন যৌক্তিকতা নেই। কারণ, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী অন্যদিকে পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদী। যখন স্বল্পমেয়াদী আমানত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হয়, তখন দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের এ্যাসেট এবং লায়াবিলিটির ক্ষেত্রে মিস ম্যাচিং হয়। সব রফতানি পণ্যে এক শতাংশ হারে করারোপ করা হয়েছে। যা না থাকলে বর্তমান সরকারের সামাজিক উন্নয়ন কাঠামো, জনকল্যাণমূলক প্রয়াস এবং রফতানিলব্ধ আয় বাড়ত। বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক স্থাপন, যশোরে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন, বিভিন্ন বিভাগে হাইটেক পার্ক স্থাপনসহ ১২টি জেলায় আইটি ভিলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। মোবাইল সেবার ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক মোটেও যৌক্তিক হয়নি। বাংলাদেশে যেসব মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ব্যবসা করছে তারা কেউই স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়ণতা, জবাবদিহিতা নিয়ে কাজ করছে না। বরং গ্রাহকের পকেট কাটছে। উচিত ছিল এই মোবাইল অপারেটরদের বেশি পরিমাণে হিডেন চার্জ নেয়ার জন্য আইনের আওতায় আনা। গ্রাহকরা বিভিন্নভাবে এদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। গ্রাহকরা যেন আর প্রতারিত না হয় সেজন্য ব্যবস্থা জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে অপরারেটরগুলো ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করে। কৃষি সম্প্রসারণের জন্য কর রেয়াত আগের মতো বহাল থাকবে, এটা অত্যন্ত ভাল একটা সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও গবাদিপশুর বিভিন্ন ধরনের খাবারের ওপর কর রেয়াতের সিদ্ধান্ত এটা নিঃসন্দেহে একটা ভাল উদ্যোগ। পাশাপাশি ভূমিকম্প প্রতিরোধের জন্য বিদেশ থেকে কোন যন্ত্রাংশ আমদানি করলে তার ওপর কর রেয়াতের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা সময়োপযোগী হয়েছে। সিগারেটের ওপর কর বৃদ্ধি করাটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। সিগারেট ও বিড়ি যত নিরুৎসাহিত হবে, তত ভাল। যেসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অতিরিক্ত মাসিক আয় করেন তাদের ওপর কর বাড়ানো, পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতালভেদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার বাবদ অসামঞ্জস্যপূর্ণ ফি আদায় দূর করার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কর বাড়ানো এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ট্রেজারি বন্ড সম্পর্কে বর্তমান বাজেটে প্রস্তাবনা যথাযথ হয়েছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূসক আরোপ করা হয়েছে। এটি যথাযথ। তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও কিন্ডার গার্টেনের ক্ষেত্রে মূসক যাতে ভালভাবে আদায় হয় সেদিকে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১.৬ শতাংশ। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি একসঙ্গে না করে আলাদা করলে ভাল হতো। কারণ শিক্ষাকে তিনটি কাঠামোতে ভাগ করা যায়। প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা। জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশটিকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাচ্ছেন এবং ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে স্থাপিত হয়েছে। মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে অবশ্যই আমাদের শতভাগ ঝরেপড়ামুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা গড়ে তুলতে হবে। সেহেতু প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়টি আরও বাড়ানো উচিত। অবকাঠামো নির্মাণ থেকে শুরু করে দুপুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খাবারের ব্যবস্থা করা এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য বাবা-মাকে সচেতনতার পাশাপাশি প্রণোদনা দেয়ার বিশেষ বরাদ্দ রাখার পদক্ষেপ থাকলে ভাল হতো। প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৬.২ শতাংশ। আমাদের মতো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সেজন্য প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় যথাযথ বলে বিশ্বাস করি। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪.৩ শতাংশ। অথচ স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়লে দু’দিক থেকে লাভ আছে। কৃষি খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৬.৮ শতাংশ। যা মোটামুটি যথাযথ। কারণ বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি খাত বেশ গুছিয়ে কাজ করছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৫.৭ শতাংশ। আসলে সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় দরিদ্র এবং অতি দরিদ্ররা যত দ্রুত বিভীষিকাময় জীবন থেকে মুক্তি পাবে, তত আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। এই খাতে বরাদ্দ যাই থাকুক প্রতিটি পাই পয়সা যেন যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৯.৭ শতাংশ। আসলে বর্তমান সরকার তার ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করার পর থেকে দেশে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলব ১৯৮২ সালের পর রেলখাতকে আবারও চালু করার প্রয়াস নেয়া। পাশাপাশি আশা করব নদীমাতৃক বাংলাদেশে যেসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলোকে যথাযথ ড্রেজিং ও সংস্কারের আওতায় এনে নতুনভাবে নৌপথ চালু করা এবং পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে, এটি ইতিবাচক দিক। সেতু নির্মিত হলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। সরকার মেট্রোরেল পথ নির্মাণসহ যাতায়াতের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪.৬ শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যয় হলে মানুষের আইনের শাসন নিশ্চিত হবে। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের ব্যয়ের আওতায় দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেটি যথাযথ হয়েছে। কারণ বর্তমান সরকারের সাফল্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুত উৎপাদন বাঞ্ছনীয়। আগামী অর্থবছরে (২০১৫-১৬) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে। যারা দেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ করে রাজনৈতিক অঙ্গনকে বিশৃঙ্খলাময় করছে তারা যদি এ ধরনের অপতৎপরতা ভবিষ্যতে না করে এবং জনকল্যাণের বিষয়টি মাথায় রেখে রাজনীতি করে তাহলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ অর্জন করা কোনভাবেই অসম্ভব নয়। বরং তার চেয়ে বেশিই অর্জন করা সম্ভব হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬.২ শতাংশ। এই মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবসম্মত। তবে এক্ষেত্রে দুটি জিনিস থাকতে হবে। একটি হচ্ছে কঠোর বাজার তদারকি, অন্যটি হচ্ছে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যেন না থাকে। সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। যেসব সরকারী প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সেগুলো সব সময় দেখা গেছে প্রকল্প হিসেবে ভাল। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় এ প্রকল্পগুলো নানামুখী সমস্যার মধ্যে পড়ে। গত ৪৪ বছর হিসেব করলে দেখা যায় এমন অনেক প্রকল্প খাতা-কলমেই রয়ে গেছে, অর্থও ছাড় দেয়া হয়েছে, কিন্তু যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। যেহেতু বর্তমানে জনদরদি সরকার ক্ষমতায়, সেহেতু সরকারের কাছে আবেদন করবো, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে প্রতিটি পাই পয়সা যেন যথাযথভাবে তদারকি করা হয়। অর্থবছর শুরুর প্রথম দিন থেকেই যেন বরাদ্দ টাকাটুকু থাকে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকে। সেজন্য তাদের এক ধরনের প্রণোদনা দেয়া উচিত। যারা প্রকল্পে দীর্ঘ সময় লাগাবে এবং নির্দিষ্ট সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন থাকল। দেশে সরকারী চাকরিজীবীদের জন্য সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক নামে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। ইতোমধ্যে দেশে মোট ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এই সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংকের অবস্থা যেন আনসার, ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ব্যাংকের মতো না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অবশ্য এ দুটি ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকিং করার কথা নয়। তবে কর্মসংস্থান ব্যাংকটিকে গতিশীল করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যেন বাংলাদেশে কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জে, শহরে, বস্তি এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা নেয়া হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে কর্মসংস্থান ব্যাংকের খোলনলচে পরিবর্তন করার জন্য আবেদন থাকল। প্রয়োজন চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে এমন লোক দেয়া যারা বর্তমান সরকারের মতাদর্শের ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশাল ভূমিকা রাখবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্মসংস্থান ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে এটি আর দশটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানের মতো পরিণত হয়েছে। অথচ কর্মসংস্থান ব্যাংকটি তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে শহরের বস্তি এলাকার বেকার জনশক্তির কর্মসংস্থান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ব্যাংক তার মূল ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্টহীন কাজে লিপ্ত রয়েছে। বর্তমান সরকার সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধি করেছে, এটি ইতিবাচক দিক। ১৩ লাখ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য বেসরকারী খাতে বেতন বৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা জেগে উঠবে। এ ক্ষেত্রে যাতে মূল্যস্ফীতি ৬.২ শতাংশ অতিক্রম না করে সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। ছিটমহলের উন্নয়নে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। মানবপাচারের কবলে যেসব বাংলাদেশী পড়েছেন তারা দেশে এলে যাতে যথাযথভাবে পুনর্বাসিত হয়, সেজন্য বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি গ্রামীণ যেসব দুস্থ মানুষ পাচারকারীর কথায় প্রলুব্ধ হয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, তারা যেন বিদেশে না যান সেজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন তার পার্টনার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জনসচেতনতামূলক কবি গান, গম্ভিরা, ভাটিয়ালি ও যাত্রাপালার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে সচেষ্ট থাকে। এজন্য বিশেষ বরাদ্দ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাশা করছি। এখনও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে যাওয়ার জন্য টেলিমার্কেটিং চলছে। সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, যারা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে হোক, স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে হোক কিংবা পানি পথে পাঠানোর ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার। পাঁচ-ছয় বছর পূর্বে একটি চক্র যুক্তরাজ্যে দেড় লাখ বাংলাদেশী শিক্ষার্থী পাঠায়। সেখান থেকে গুটিকয়েক রেখে বাকিদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। এজন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের নতুন করে আইন প্রণয়ন করে তার আওতায় আনতে হবে। আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছি এবং গত ছয় বছরে সামাজিক ও নিরাপত্তা খাত আরও বেশি জোরদার হয়েছে, তাই সময় এসেছে সামাজিক কাঠামো সম্প্রসারণ করা, সরকারী ও বেসরকারী অদক্ষতা দূর করা এবং দুর্নীতি হ্রাস করা। বর্তমান বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী অতিদারিদ্র্য এবং দারিদ্র্য হ্রাস করার যে ঘোষণা করেছেন, এটি হয়ে উঠুক এদেশের মানুষের মুক্তির দিশা। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। তাঁর কন্যার হাত ধরে আমাদের দেশ এগিয়ে চলছে সুন্দরভাবে। এদেশের প্রতিটি ঘরে প্রতিটি মানুষ ক্ষুধামুক্ত থাকুক, শ্রমজীবী থেকে শুরু“করে উচ্চবিত্তের মধ্যে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা সুষম হোক। অত্যন্ত দরিদ্র্য মানুষটি খেয়ে-পরে মানুষের মতো বাঁচুক। কর্মদক্ষতা এবং অর্থনীতির ঝুঁকি হ্রাস পাক। বিশ্ব মানচিত্রে ২০২১ আমাদের প্রতিষ্ঠিত করুক একটি সম্মানজনক দেশ হিসেবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। যারা জনকল্যাণ, সমাজিক কল্যাণ এবং অবকাঠামোর উন্নয়নের প্রয়াসকে ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন না তারা বর্তমান সরকারের সৎ উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হবেন। রাজনীতির অধীনেই অর্থনীতি এগিয়ে চলে এবং বাজেট হচ্ছে বস্তুতপক্ষে একটি বছরের হিসাব-নিকাশ ও কিছু নীতিমালার সম্মেলন। অন্যদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী হচ্ছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার এক বছরের অংশ বিশেষ। আগামী পহেলা জুলাই যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু“হতে যাচ্ছে তা যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কথা ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে হবে। ভৌতকাঠামোর পাশাপাশি সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে জোর দিতে হবে। যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের প্রয়াস নিতে হবে। যেহেতু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা ভিশন- ২০২১ দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এখন আর পেছনে ফেরার অবকাশ নেই। বরং এটি একটি স্বস্তির বিষয়, সাধারণ জনকল্যাণ ও সামগ্রিক অর্থনীতিকে সামষ্টিক ও বেষ্টিক অর্থনীতির যুগপৎ সম্মিলন। এই প্রত্যয়টি প্রতিটি মানুষের মধ্যে গেঁথে দেয়া দরকার এবং এই লক্ষ্যে সবাই যদি কাজ করে তাহলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও শিক্ষাবিদ ঢ়রঢ়ঁষনফ@মসধরষ.পড়স
×