ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

স্বাগত মোদি ॥ অভিনন্দন শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৭ জুন ২০১৫

স্বাগত মোদি ॥ অভিনন্দন শেখ হাসিনা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বাংলাদেশে এসেছেন গতকাল শনিবার। দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফর, দুই দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের একটি আকাক্সক্ষার বাস্তবরূপ দিয়ে আজ রবিবার ফিরে যাবেন নিজ দেশে। এটি নিছক কোন সৌজন্যমূলক সফর নয়। মোদি এসেছেন ৪১ বছর যাবত ঝুলে থাকা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার স্থলসীমা নির্ধারণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দুই দেশের স্থলসীমা নির্ধারণ করে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন ১৯৭৪ সালে, যা ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ নামে খ্যাত, যার মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন আর সুদৃঢ় করার যে দিগন্ত উন্মোচন করে যান, মোদির এই সফর তারই আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখাবে। এটি হবে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যুগলবন্দী ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনা। সেই সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শ্রী নরেন্দ্র মোদি ও দেশরতœ শেখ হাসিনা। আমরা শ্রী মোদিকে স্বাগত জানাই, সেই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই শেখ হাসিনাকে তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক ক্যারিশমার জন্যে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে যে কংগ্রেস এই ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ বাস্তবায়নে বিজেপি কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে সেই বিজেপিই যখন আজ তা বাস্তবায়নে এগিয়ে এলো তখন কিন্তু কংগ্রেস প্রতিশোধ নেয়নি, বরং বিল আকারে ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সমর্থন দিয়ে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করে নিতে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। এ জন্যে কংগ্রেস সভানেত্রী শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধীকেও ধন্যবাদ জানাই। সীমা নির্ধারণ চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ভারত বাংলাদেশকে ছেড়ে দেবে, যার ভূমির পরিমাণ ১৭১৬০.৬৩ একর। পক্ষান্তরে ভারতের ভূখ-ের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতকে ছেড়ে দেবে বাংলাদেশ, যাতে ভূমির পরিমাণ ৭১১০.০২ একর। আমরা ভূমি বেশি পেয়েছি অবশ্যই, তারপরও বলব ভূমি বেশি বা কম এটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো হৃদয়ের আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুই দেশের সরকারও জনগণের মধ্যে আবেগের বিনিময় হবে। ভারত কেবল বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশই নয়, উঠতি অর্থনৈতিক জায়ান্টও, বাংলাদেশও মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে, উপরন্তু উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি এবং সফলভাবে জঙ্গী দমন করে কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, তামাম দুনিয়ায় সফল সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ছিটমহলের দেশহীন মানুষ আপন দেশ পেয়েছে আজ, আপন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছে, সর্বোপরি পেয়েছে আত্মপরিচয়। যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিবেশী সুলভ সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে পাশাপাশি এগিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়া হয়। পাকিস্তান মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের জিয়া ভারতবিরোধী কার্ড খেলে বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু আক্কেলহীন মুসলিম দেশ জিয়াকে আর্থিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দেয়। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতা রচিত এই পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন করে জিয়া ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ভারতের সঙ্গে বৈরিতা’- এই নীতি অবলম্বন করে একযোগে পাশাপাশি হাঁটার পর রুদ্ধ করে দেয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ভারতবিরোধিতার কার্ড তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের যেমন পলিটিক্যাল পুঁজি ছিল, ঠিক তেমনি মিলিটারি জিয়ারও তা পুঁজি হয়ে দাঁড়ায়। জিয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত বাতিল মাল মুসলিম লীগ এবং সরাসরি অস্ত্র হাতে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মুনাফিক জামায়াত-শিবির নিয়ে দল করে। এর বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না তার। জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের যারা জিয়ার পলিটিক্যাল প্ল্যাটফরমে যোগ দেয়নি, সেই সব রাজাকার, আলবদর, আলশামস, যাদের দলগতভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, জিয়া তাদেরও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে কোলে টেনে নেন। দেশদ্রোহিতার দায়ে নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া গোলাম আযম, শাহ আজিজের মতো ঘৃণিতদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত ফেরত দেন। জিয়ার এই ভ্রান্তনীতি বিচারপতি সাত্তার, মিলিটারি এরশাদ, হাফ-মিলিটারি খালেদা অনুসরণ করে। তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অসন্তোষ সৃষ্টিকারীদের বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার, তাদের প্রশিক্ষণ, পাকিস্তান থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র গোলাবারুদ এনে সরবরাহ করতে থাকে। খালেদা জিয়ার আমলে আন্তর্জাতিক টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশান আল কায়েদা, মুসলিম ব্রাদারহুড, আইএস, বোকো হারামের আদলে বাংলাদেশে হিজবুল মুজাহিদীন, হিজবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম এমনি নানান নামের গোপন সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। তাদের বাংলাদেশে নাশকতা চালানোর পাশাপাশি ভারতে গিয়ে নাশকতা চালানোর পথ করে দেয়। খালেদা জিয়ার আমলে ভারতবিরোধিতার কার্ড এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বাংলাদেশে নির্বাচন এলে বলা হতো- আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে (পাকিস্তান আমলে বলা হতো যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে)। ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা যখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করে ঐ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান করলেন, তখন খালেদা জিয়া বললেন, শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ফেনী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পুরো এলাকা ভারত হয়ে যাবে। নির্বাচনী প্রচারে খালেদা জিয়া আরও যে কথাগুলো বললেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদে তালা পড়বে, আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে, মানুষ টুপি মাথায় দিতে পারবে না ইত্যাদি। এভাবে দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে চিড় ধরিয়ে দেয়া হলো। এ যেন বিধির বিধান। বঙ্গবন্ধু যে জায়গাটায় সমাধানের পথ এবং আলোচনা রেখে যান, তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাতে এক এক করে সমাধান হচ্ছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত সফর করেন এবং তখনকার ক্ষমতাসীন ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএসসি) প্রধান শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী এবং কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো আবার মীমাংসার টেবিলে আনেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার সীমান্ত নির্ধারণ সংক্রান্ত ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে অনুমোদন করা হলেও তা ভারতীয় পার্লামেন্টে অনুমোদন লাভ করেনি। তখন বিরোধিতাকারীদের মধ্যে যারা ছিল তাদের সমন্বয়ে চরম দক্ষিণপন্থী ধর্মান্ধ বিজেপি গঠিত হয়। এরই মধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকেও হত্যা করা হয়। জিয়ার রেখে যাওয়া খালেদা-বিএনপি ভাবল এবার বিজেপিকে দিয়ে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করা যাবে। কিন্তু বিজেপি আর বিএনপির মধ্যে পার্থক্য হলো, বিজেপি ধর্মান্ধ হলেও তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতাকারী দল নয়, বরং স্বাধীনতা সংগ্রামী দল পক্ষান্তরে জামায়াত-শিবির (সঙ্ঘ)- মুসলিম লীগসহ যারা মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাদের নিয়ে জিয়া বিএনপি গঠন করেন। তাই বিজেপি কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও জাতীয় স্বার্থে কংগ্রেসের সঙ্গে এক সঙ্গে চলে অথচ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগবিরোধিতা দেশের স্বার্থের বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়। আর তাই নরেন্দ্র মোদি (যেহেতু শিক্ষিত) তার নিজ দেশের স্বার্থেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান খুঁজলেন। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সঙ্গেই আলোচনায় বসলেন, সমাধান বের করলেন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ভিত্তিতেই। মোদি বোঝেন তুলনায় বাংলাদেশ যত ছোটই হোক, রয়েছে ৪ হাজার কিলোমিটার স্থলসীমান্ত। এ অবস্থায় শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশে বসবাসের জন্যে বাংলাদেশও ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো মোদি ঢাকায় আসছেন। তিনি এমনই কূটনৈতিক শিষ্টাচার দেখিয়েছেন যে, দিল্লীতে বসে অর্থাৎ তার নিজ বাড়িতে বসে সমাধান না করে আমাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে সমাধান করতে এসেছেন। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জীও এসেছেন। তবে যদ্দুর জানা গেল এবং বিশ্লেষকদের ধারণা তিনি এখনও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতা থেকে সরে আসেননি। বিশ্লেষকরা মনে করেন তিস্তা চুক্তি এই সফরে না হলেও একটা এম.ও.ইউ (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারন্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর হলেও হতে পারে। বিএনপি এখন বলছে তারা কোনদিন ভারত বিরোধিতা করেনি, এখনও করছে না, ভবিষ্যতেও করবে না। বিএনপি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন বিএনপির নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। আমি মনে করি ঠেলায় পড়ে বাধ্য হচ্ছে। প্রথমত মোদির নির্বাচনের রেজাল্ট চূড়ান্তভাবে প্রকাশ হওয়ার আগে কেউ মালা হাতে দিল্লী দৌড়ে, কেউ ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের গেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুল হাতে অপেক্ষা করেও ভগ্ন মন নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত দেশাভ্যন্তরের রাজনীতিতে পেট্রোলবোমা ছুড়েও যখন শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে ব্যর্থ হতে হলো, তখন মোদির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায়ইবা কি? বিএনপির এ অবস্থানেরই নাম ভারতের দালালি। আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিকামী বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ এ জন্য যে, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আশ্রয়, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এ জন্যে যে, তিনি আমাদের সঙ্কটে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা নিয়ে। এরই নাম কৃতজ্ঞতা। আর বিএনপি যা করেছে তার নাম দালালি। এখন কান্নাকাটি করছে বাংলাদেশ সফরকালে মোদির সঙ্গে দেখা করার জন্য অথচ এই বিএনপিই ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জীর সফরকালে তার সঙ্গে দেখার করার এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তা বাতিল করে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে অপমান করেছিলেন। মোদির সামনে সে উদাহরণ রয়েছে। বিএনপি কিন্তু তা বোঝে না। বুঝবেই বা কেমন করে, বিএনপি এখন চালায় এক প্রফেসর, এক এ্যাডভোকেট, সঙ্গে রয়েছে কতিপয় অর্বাচীন সাংবাদিক বা টকশোর গলাবাজ। বিএনপি নীতি নির্ধারণী নেতারা এ সুযোগে লম্বা ঘুম দিয়েছেন এবং সহসা এই ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। ঢাকা ॥ ৬ জুন ২০১৫ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
×