ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি’র ভারতপ্রীতি!

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৭ জুন ২০১৫

বিএনপি’র ভারতপ্রীতি!

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিএনপি’র ভারতপ্রীতির মহড়া প্রদর্শনের চেষ্টা গত কিছুদিন ধরে তাদের প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও এই রাজনৈতিক দলটির জন্মই হয়েছিল ভারতের বাংলাদেশ সংক্রান্ত কার্যক্রমকে হেয় প্রতিপন্ন করাসহ ভারতবিরোধী সেøøাগান তোলার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার সঙ্গে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের এবং পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগের কতিপয় ব্যক্তির উৎসাহ ও সহযোগিতায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে এ দলটির জন্ম হয় তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে। মূলত মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় তথাকথিত ‘সিপাহী বিপ্লবের’ পথ ধরে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানী মনোভাবাপন্নদের ইন্ধনে এবং ভারতীয় দূতাবাস আক্রমণকারীদের সহায়তায় ভারতবিরোধী চক্র হিসেবে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জেঁকে বসে তথাকথিত ৭ নবেম্বরের পরবর্তী সময় থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় সুদীর্ঘকাল ধরে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরেছিল বিএনপি সরকার। আর এর পুরোটা সময়ই ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচার অব্যাহত ছিল। প্রমাণ হিসেবে ৭ নবেম্বরের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় দালালের মিথ্যা ধুয়া তুলে মুক্তিযোদ্ধা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দারসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত ও হত্যা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের চিহ্নিত বিরোধিতাকারী ও স্বঘোষিত পাকিস্তানপন্থীদের জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর পরই ব্যাপকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতার অংশীদার, অর্থনৈতিক পরিম-লে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় জায়গায় এদের পুনর্বাসিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অন্যতম কর্ণধার শাহ আজিজের মতো ঘৃণিত রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসএ কর্তৃক এ সকল কার্যক্রমে বিএনপি’র পৃষ্ঠপোষকতাকে সরাসরি সহায়তা প্রদান করা হয়। ৭ নবেম্বর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের পর পাকিস্তানী আইএসআই’র উৎসাহে প্রথম আক্রমণ করা হয় ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে। মওলানা ভাসানীর মাধ্যমে তাকে যথাযথ সহায়তা প্রদান করে ফারাক্কা ব্যারেজ অভিমুখে লংমার্চ-এর মতো ঘটনা ঘটানো হয়। যে তালপট্টি দ্বীপের বাস্তবে কোন অবস্থান নেই, সে তালপট্টি নিয়ে ভারতকে বাংলাদেশে তালপট্টি ছেড়ে দেয়ার বহু মনগড়া ঘটনা অপপ্রচার করে ভারতের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতিও সৃষ্টি করে। গত কয়েক বছর আগে রৌমারীতে ইউজ ঠং ইঝঋ -এর মধ্যে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সংঘর্ষ সংঘটিত করা হয়। ইঝঋ সদস্যদের হত্যা করে বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে বহন করে গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। ভারতীয় পক্ষের মধ্যে তা ব্যাপক অসন্তোষ ও অসম্মানজনক প্রভাব ফেলে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে নেতৃত্ব প্রদানকারী তৎকালীন ইউজ ঈযরবভ মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান যিনি বর্তমানে আওয়ামী বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, যিনি ঐ সময়েও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁর সুদূরপ্রসারী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে তখন বাংলাদেশ এবং ভারত একটি যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পায়। জিয়াউর রহমানের শাসনকাল থেকে শুরু করে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালীন সব সময়েই বাংলাদেশকে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর (টখঋঅ) অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলে তো অনেক সময় মনে হতো টখঋঅ বাংলাদেশের শাসনকার্য নিয়ন্ত্রণ করছে। এ প্রেক্ষিতে জামায়াত নেতা মাওলানা নিজামীর নেতৃত্বে দশ ট্রাক অস্ত্রবাহী চালান আটক হওয়ায় জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়Ñ যা ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত প্রদেশসমূহে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আইএসআই’র সহায়তায় আনা হয়। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বাংলাদেশের ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। আর এ এলাকায় উত্তোলিত হবে ভারতীয় পতাকা এবং ঘরে ঘরে আজানের পরিবর্তে শঙ্খ ও উলুধ্বনি শোনা যাবে (উল্লেখ্য, উলুধ্বনি আনন্দ প্রকাশ করতে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে দেয়া হয়ে থাকে)। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন ভারতীয় পতাকা তৈরি করে চট্টগ্রামে রাউজানের বাড়িতে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও এই বিএনপি-জামায়াত জোটই আওয়ামী লীগকে ভারতের দালাল বলে আখ্যায়িত করত। ভারতের সঙ্গে যত অমীমাংসিত ও বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চুক্তি আওয়ামী লীগ শাসন আমলেই সম্পাদিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা আবার আওয়ামীলীগ আমলে ভারতের লোকসভা ও বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল পাস হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সব সময়ই বাংলাদেশের নাগরিকদের মনে ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃজনে চেষ্টা করেছে। তাদের শাসনকালেই সর্বাধিক সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশের নাগরিক দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়, তাদের সহায় সম্পদ লুণ্ঠন করে নেয়া হয়, রাষ্ট্রের ন্যায্য সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষত হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়। সবই করা হয় পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ওঝও-এর নির্দেশনা ও পরিকল্পনা অনুসারে। এ কথা ভুললে চলবে না ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-এর বাংলাদেশ সফরকালে বিএনপি-জামায়াত জোট ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর বাংলাদেশ সফরকালে ২০ দলীয় জোট আহূত হরতালের অজুহাতে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতকারে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে কার্যত অপমান করা হয়। এই বিএনপিই এখন ভারতপ্রেমিক সাজার চেষ্টা করছে। হায় সেলুকাস! কি বিচিত্র এই বাংলাদেশ! কি বিচিত্র তাদের রাজনীতি! লেখক : সংসদ সদস্য
×