ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে

প্রস্তাবিত বাজেট উচ্চাভিলাষী নয় ॥ সিপিডি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৬ জুন ২০১৫

প্রস্তাবিত বাজেট উচ্চাভিলাষী নয় ॥ সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত বাজেট উচ্চাভিলাষী নয়, তবে বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার’ কারণ রয়েছে বলে মনে করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বে দেশের অর্থায়নে রাজস্বের পরিমাণ কমেছে এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এটা কোনভাবেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। শুক্রবার বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনায় সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার প্রতিষ্ঠানের মতামত তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন তার মূল্যায়ন তুলে ধরতেই এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রবৃদ্ধির সোপান আরোহণের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন কঠিন বলে মনে করে সিপিডি। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে সোপানের পথ পিচ্ছিল হয়ে উঠবে। তাই সোপানের পথটি মসৃণ করতে হবে বলে তাঁরা মত দেন। বাজেটের বিভিন্ন খাতে পাঁচটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে সিপিডি। সিপিডির মতে, এবারের বাজেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও ভাল দিক হলো শিশু বাজেট। সবচেয়ে অনুজ্জ্বল হলো ঘোষণা ছাড়া জেলা বাজেট বাদ দেয়া। বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, এখন যে ব্যয় ধরা হচ্ছে তা বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না। সেই অর্থে একে তথাকথিত উচ্চাভিলাষী বাজেট আমরা বলি না। আমাদের দেশে জিডিপির ১৭ শতাংশ হলো রাষ্ট্রীয় ব্যয়। আমাদের সঙ্গে তুলনীয় অনেক দেশ আছে, যারা জিডিপির ২২ শতাংশের উপরে ব্যয় করে। বাংলাদেশও এখানে আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু এটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ কোথা থেকে আসবে তাও বের করতে হবে। বাজেট প্রস্তাবে মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয়ের পরিকল্পনা দেখিয়েছেন মুহিত। এই অর্থের ৬০ শতাংশই আসবে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর থেকে। তবে এই লক্ষ্য অনুযায়ী বাজেটের অর্থায়ন সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান সিপিডির গবেষকরা। মুহিতের বাজেট প্রস্তাবে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি রয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ হিসাবে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি বিদেশী সহায়তা হিসাবে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা পাওয়ার আশার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যয় মেটাতে রাজস্ব উদ্বৃত্ত বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে না। ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বৈদেশিক রিজার্ভ রেকর্ড অতিক্রম করার পরও বাজেটে ব্যাংক ঋণ নির্ভরতার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেটে সুদ পরিশোধ হিসেবে ৩১ শতাংশ ব্যয় নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সুদ পরিশোধ দেখিয়ে বড় বাজেট ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায়’ খাওয়ার মতো। আবার প্রতিশ্রুত বিদেশী সহায়তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে ‘এই কাঠামো ভেঙে বের হওয়ার’ ওপর জোর দেন সিপিডির ফেলো। অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করে যে বাজেট কাঠামো দেয়া হচ্ছে, তা মন্দাকালীন সময়ে চললেও এটা অব্যাহত থাকতে পারে না। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে সম্প্রসারণশীল মডেল অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বিদেশী সহায়তা ব্যবহারের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দেবপ্রিয় বলছেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে হলে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিদেশী সহায়তা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে। আর এটা না করতে পারলে ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা বাড়বে। আর এর আগে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশী সহায়তা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা না থাকায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে আগামী ‘তিন বছর’ ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকবে বলেও দেবপ্রিয়র ধারণা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচীতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে সড়ক অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পল্লী উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান। দেবপ্রিয় মনে করছেন, উন্নয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতে আরও বরাদ্দ দরকার। উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারণ ও ‘সঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ না করতে পারারও’ সমালোচনা করেন তিনি। দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে নতুন বাজেট নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও বিদায়ী বাজেটের অর্জন নিয়ে পর্যালোচনা থাকে না। বিদায়ী বছরের লক্ষ্য অর্জনের তথ্যও বাজেটে রাখার দাবি জানান তিনি। অর্থায়ন নিয়ে মুহিতের সমালোচনা করলেও রাজস্ব আদায়ে তার বেশকিছু পদক্ষেপের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন সিপিডির এ ফেলো। দেবপ্রিয় বলেন, কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসে কর বাড়ানোরও পক্ষে আমরা। পোশাক রফতানির ওপর উৎসে কর বৃদ্ধিকে যৌক্তিক মনে করলেও চিনির আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব ‘ইতিবাচক হয়নি’ বলে সিপিডি মনে করে। আর মোবাইল ফোনের সিম বা রিমের মাধ্যমে সেবায় ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব সবার ক্ষেত্রে আরোপ না করে ন্যূনতম একটি ব্যয়সীমা পর্যন্ত ছাড় দেয়ার পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়। সিপিডির বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ও রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ সময় ধরে চললেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। তবে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় মনে করেন, বাংলাদেশের সামরিক ব্যয় ভারত বা পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম। একই সঙ্গে সিপিডির গবেষণা তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৬, বড় জোর ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এর জন্য ২০২১ সালের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর মেস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
×