ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তিসহ ১৯টি চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে ;###;উদ্বোধন হবে নয়টি কর্মসূচী ;###;বিকেলে শেখ হাসিনা-মোদি বৈঠক

ঢাকা-দিল্লী গভীর ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়াই লক্ষ্য ॥ মোদি আসছেন আজ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৬ জুন ২০১৫

ঢাকা-দিল্লী গভীর ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়াই লক্ষ্য ॥ মোদি আসছেন আজ

তৌহিদুর রহমান ॥ ঢাকা ও দিল্লীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ শনিবার ঢাকা আসছেন। এই সফরের মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে দুইদিনের সফরে ঢাকা আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মোদির সফরে দুই দেশের মধ্যে ১৯টি চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এছাড়া মোদির সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ৯টি কর্মসূচীর উদ্বোধন হবে। এদিকে মোদির সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় একটি বিশেষ বিমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছবেন। বিমানবন্দরে নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে আসছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, পররাষ্ট্র সচিব ড. এস জয়শঙ্কর। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদির সফর উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকা এসেছেন। মোদির সফরে সরকারী প্রতিনিধি দলে মাত্র ১২ জন সদস্য রয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর উপলক্ষে রাজধানীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন অধ্যায় শুরু করতে চলেছেন বলে মনে করছেন। ঢাকা আসার আগে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শান্তি এবং স্থায়িত্ব নিয়ে আসবে। সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে সংসদের অনুমোদন নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিটি করতে চলেছে ভারত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এই সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গঠনের পরেও সেই বিতর্ক বহাল রয়ে গেছে। আমরা এই বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি এবং সেটা সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। এটা আদৌ সামান্য ঘটনা নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে গত এক বছরে মোদি এ পর্যন্ত ১৯টি দেশ সফর করেছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় গেছেন। বাংলাদেশে অনেক আগেই আসতে চেয়েছিলেন মোদি। তবে সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের জন্য তার সফরে দেরি হয়। ভারতের পার্লামেন্টে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল পাস হওয়ার পরে তিনি এখন ঢাকা আসছেন। তিস্তা নিয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান ॥ তিস্তা চুক্তি নিয়ে ‘ধৈর্য ধরার’ পরামর্শ দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, সব কিছু ‘রাতারাতি হয় না’। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের আগের দিন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন মন্ত্রী। শনি ও রবিবার মোদির ঢাকা সফরে যে বহু আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে না, তা আগেই ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছিল। মাহমুদ আলীও সংবাদ সম্মেলনে সে কথাই জানিয়েছেন। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সফরের সময় তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এই আলোচনা চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। ডিপ্লোমেসিতে সব কিছু তো পাবলিকলি হয় না। অনেক কিছুই চোখের আড়ালে হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসে ‘শিগগিরই তিস্তার জট খোলার’ আশা দেন মমতা। এরপর মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতারও আসার আলোচনা শুরু হলে পুরনো কাঠামোতে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবারও বেঁকে বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা সফরে ‘তিস্তা চুক্তি না করার’ আশ্বাস দিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে আসতে রাজি করান বলে জানা গেছে। গত ১ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ স্পষ্টই জানিয়ে দেন মোদির সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হচ্ছে না। শুক্রবার মোদির সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে এলেও তিস্তা নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাকে। ‘চোখের আড়ালে’ তিস্তার আলোচনা প্রসঙ্গে মাহমুদ আলী বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর এ জন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করেছি। আর আমাদের সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমরা নিশ্চই এ বিষয়ে আরও আলোচনা করব। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের আলোচনায় আঞ্চলিক যোগাযোগের বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে। ঢাকা সফর নিয়ে উচ্ছ্বসিত মোদিও বৃহস্পতিবার রাতে এক টুইটে লিখেছেন, আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে আমার বাংলাদেশ সফর আমাদের বন্ধন আরও মজবুত করবে এবং তাতে দুই দেশের জনগণই উপকৃত হবে। বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের সব বাধা কাটিয়ে ওঠার পর নরেন্দ্র মোদির এই সফর। ৪১ বছর ধরে ঝুলে থাকা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পথ তৈরি হওয়ায় দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫ হাজার মানুষ জীবন বদলের স্বপ্ন দেখছে। সেই স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রোটোকলে দুই দেশের অনুসমর্থনের দলিল মোদীর সফরে বিনিময় হবে বলে মাহমুদ আলী সংবাদ সম্মেলনে জানান। ১৯ চুক্তির প্রস্তুতি ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে আন্তঃযোগাযোগ, সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য সহযোগিতার মতো অন্তত ১৯টি বিষয়ে চুক্তি ও আলোচনা হওয়ার কথা, যার মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্থল সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের দলিল বিনিময় হবে। মোদির সফরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল, উপকূলীয় নৌ চলাচল চুক্তি, পণ্যের মান স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি হবে। এছাড়াও দুই দেশের উপকূলীয় অঞ্চল নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, মানবপাচার প্রতিরোধ, জাল নোট পাচার প্রতিরোধ, সমুদ্র অর্থনীতি বিকাশে সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক সই হবে। ৯ কর্মসূচী উদ্বোধন ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ৯টি কর্মসূচীর উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সেবা, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সেবা চালু। এছাড়া খুলনা-মংলা রেল লাইন, কুলাউড়া-শাহাবাজপুর রেল সংযোগ পুনর্বহাল, শিলাইদহের কুঠিবাড়ীতে রবীন্দ্রভবন, সারদা পুলিশ একাডেমিতে একটি মৈত্রী ভবন, ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প, বিএসটিআই-এর একটি পরীক্ষাগার ও একটি সীমান্ত হাট উদ্বোধন করা হবে। মোদির সফরসূচী ॥ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা পৌঁছার পর শাহজালাল বিমানবন্দরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হবে। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানাবেন। ঢাকা পৌঁছার পর নরেন্দ্র মোদি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সেখান থেকে তিনি যাবেন ধানম-িতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। শনিবার দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক হবে নরেন্দ্র মোদির। একই দিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও থাকবেন। রবিবার সকালে ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন ছাড়াও বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বক্তৃতা দেবেন মোদি। এরপর সন্ধ্যায়ই তিনি ঢাকা ছাড়বেন। ১০০ প্রকার নিরামিষ ॥ ঢাকায় প্রথমবারের মতো আসছেন মোদি। আর অতিথি পরায়ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। তাই মোদিকে আপ্যায়নের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। মোদির সফরে অনন্ত ১০০ রকমের নিরামিষ রান্নার আয়োজন করা হয়েছে। খাদ্য তালিকায় থাকছে মসুর ডাল ও নানা ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি ‘মসলা খিচুরি’। সঙ্গে থাকবে নানা ধরনের এবং স্বাদের ডালনা, সর্ষে দিয়ে সজনে ডাঁটা, আমের চাটনি। মোদির নিজস্ব পছন্দ ‘ভে-ি কড়ি’, ভে-ি অর্থাৎ ঢেঁড়স আর দুধ দিয়ে তৈরি। মোদির পছন্দের গুজরাটি খাবার ‘সাদা খাট্টা ধোকলা’ও থাকবে। এ সবের সঙ্গে থাকবে তাজা ফল, আর অবশ্যই বাংলাদেশের বিখ্যাত পিঠেপুলি, পায়েস, ক্ষীর, সন্দেশ। এগুলোর পাশাপাশি ঢাকা থেকে মোদির খাবারের পছন্দের তালিকা জানতে চাওয়া হয়। সেই হিসেবেই এসব রান্নার আয়োজন করা হয়েছে।
×