নিখিল মানখিন ॥ দেশে নবজাতকদের সুরক্ষায় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অনেক সঙ্কট রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য গড়ে মাত্র ৫ জন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীর এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ রয়েছে। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিশু মৃত্যু হার কমাতে হলে অবশ্যই নবজাতকদের মৃত্যুর হার কমাতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা শীর্ষক সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়েছে। তবে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের ব্যাপক সাফল্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, সরকারী ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষভাবে যারা নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষিত, তাদের এলাকা অনুযায়ী বিন্যাসের পর্যালোচনা করা হয়। বাড়িভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ৩০ থেকে ৬০ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধ করতে পারে। সে জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের জন্মের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবা (ইএনজি) বিষয়ে প্রশিক্ষিত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে নবজাতকের বাড়ি পরিদর্শন করার জন্য সুপারিশ রয়েছে। ‘ইএনজি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীই পারে সঠিকভাবে বুকের দুধ পান করানো, পরিচ্ছন্নতা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং শিশুকে উষ্ণ ও শুকনো রাখা বিষয়ে নতুন মাকে শেখাতে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সরকারের কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীর এক তৃতীয়াংশেরও কম ‘ইএনজি’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ আছে। সরকারী প্রতিশ্রুতি পূরণে সব স্বাস্থ্যকর্মীকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক কিছু তারতম্য রয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য মাত্র ১ জন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীর এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ রয়েছে। রংপুর বিভাগে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ রয়েছে প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য ১৬ জন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীর বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ নবজাতক মারা যায়, যা সুইজারল্যান্ডে প্রতি ১ বছরে জন্ম নেয়া মোট শিশুর সমান। তাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ নবজাতক মারা যায় জন্মের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে। অথচ তাদের বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য।
তবে বিবিসি বাংলা বলছে, পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার কমানো ও সন্তান জন্মদানের সময় মায়েদের মৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। দ্য পার্টনারশিপ ফর ম্যাটারনাল এ্যান্ড চাইল্ড হেলথ নামে এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০টি অনুন্নত ও দরিদ্র দেশের তালিকা দেয়া হয়েছে যারা শিশু ও মায়েদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে তাদের আর্থিক সামর্থ্যরে তুলনায় অনেকদূর এগোতে সমর্থ হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এতে বলা হচ্ছে, গত ১২ বছরে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়েছে ৭২%। অন্যদিকে এই একই সময় বাংলাদেশে প্রতি লাখে জন্মে মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে ৬৯%। এই সাফল্যের জন্য সবচাইতে বড় কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে, সরকারের বিস্তৃত টিকা দান কর্মসূচী ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীকে। সেই সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সফল পার্টনারশিপ, যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি এবং মেয়েদের শিক্ষায় উন্নতির বিষয়টিও বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, মা ও শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। শুধু আমাদের একার পক্ষে শতভাগ সফল হওয়া সম্ভব নয়। সমন্বিতভাবে কাজ করলে এ ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সেবা কেন্দ্রসমূহে প্রসবের হার ৯.২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৩.৪ শতাংশ, প্রসবজনিত সমস্যায় সেবাকেন্দ্র ব্যবহারের হার ১৬ থেকে ২৯ শতাংশ এবং পূর্ণমাতৃ-পরিচর্যা (প্রসব পূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর) ৫ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া বাধাপ্রাপ্ত বা দীর্ঘায়িত প্রসব, এ্যাবরশন ইত্যাদি কারণেও মাতৃ মৃত্যু আগের তুলনায় কমেছে। বর্তমান অগ্রগতির কারণ হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ, নারী শিক্ষার অগ্রগতি, সেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সু-ব্যবস্থা রয়েছে। বিভাগীয়, জেলা ও থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়াও বর্তমানে সারাদেশে মোট ১২ হাজার ৫৫০ ক্লিনিক চালু আছে এবং এ সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া ৫৮১ ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালিত হচ্ছে। সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টায় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। শিশু পুষ্টি কার্যক্রম আরও জোরালো করেছে সরকার। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শিশু পুষ্টি কার্যক্রমেও নতুন কর্মসূচী আসছে। এ এদেশের প্রজনন হার ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিতদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য গড়ে উঠেছে। এ কারণে মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা খুব যতœ ও সতর্কভাবে পরিচালিত হয়ে থাকে।