ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাজেট ও রমজানপূর্ব গরম বাজার ॥ সমাধান কী?

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৬ জুন ২০১৫

বাজেট ও রমজানপূর্ব গরম বাজার ॥ সমাধান কী?

আমি কলাম লিখছি তিন তারিখে অর্থাৎ বুধবার, ৩ জুন। পরদিন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের নতুন বাজেট উত্থাপিত হবে। বাজেটে কী আছে, কী নেই এর কিছুই আমার জানা নেই, এই মুহূর্তে। বলা যায় আমি বাজেট সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে। এমতাবস্থায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট এবং চলতি বছরের (২০১৪-১৫) বাজেট পারফরমেন্স সম্পর্কে কিছু বলা কোনভাবেই সঙ্গত নয়। তবে একটি জিনিস অবশ্যই উল্লেখ করা যায় আর তা হচ্ছে বাজেট ঘোষণাকালীন অবস্থা। দেখা যাচ্ছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটটি হবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম বাজেট। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট দিয়ে অর্থাৎ এ মাসের ৩০ তারিখে শেষ হচ্ছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। এই দিক দিয়ে নতুন বাজেটের গুরুত্ব ভিন্ন মাত্রার। কারণ, এ দিয়ে বোঝা যাবে আমরা সপ্তমবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজটা কীভাবে শুরু করতে যাচ্ছি। এদিকে নতুন বাজেটটি ঘোষিত হচ্ছে এমন সময়ে যখন পবিত্র রমজান মাসের আর বেশি বিলম্ব নেই। দেখা যাচ্ছে বাজেট ও রমজান মাসকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা পুনরুদ্ধারকৃত উদ্যমে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। এরই মধ্যে আবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ‘এফবিসিসিআই’ (ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) -এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এবং একজন বাস ব্যবসায়ী তার নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন। তিনটি জিনিসই কাকতালীয়, কিন্তু একটি আরেকটি সম্পর্কে আলোচনার উস্কানি দেয়। বাজেটে কী কাছে, কী নেই ইতোমধ্যেই দেশবাসী জেনে নিয়েছেন। এবং ফল কার কপালে কী পড়েছে তাও বুঝতে পেরেছেন। আমি এই আলোচনা পরের সপ্তাহে করব। ইতোমধ্যে যা দেখতে পাচ্ছিÑ বাজেট ঘোষণার পূর্বেই এবং একজন ব্যবসায়ীবান্ধব বাণিজ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা যথেচ্ছভাবে জিনিসিপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছেন এবং সময়টা এমন সময় যখন ‘এফবিসিসিআই’-এর নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। তিনি নির্বাচনের পরপরই বলে দিলেন, তার প্রথম কাজ হচ্ছে ব্যাংকের লেন্ডিং রেট এক অঙ্কের ঘরে নামানো। দুঃখিত, এর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে পারলাম না। কারণ, দেখা যাচ্ছে তার নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকেই তার ভোটার ও সমর্থকরা ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো শুরু করেছে বাজেট ও রমজান মাসকে উপলক্ষ করে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন জিনিসের দাম বাড়েনি। তাহলে কেন সয়াবিন, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, মসলা, চিনি, ছোলা ইত্যাদি জিনিসের দাম বাড়বে? এটা কী বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য এবং তার মাধ্যমে এমন সরকারকে ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য যে সরকার দাবি করার আগেই ব্যবসায়ীর প্রতি সদাচার করে? আমি আশা করেছিলাম বাস ব্যবসায়, এজেন্সি ব্যবসায় সফল ‘এফবিসিসিআই’-এর নতুন প্রেসিডেন্ট মাতলুব আহমাদ সাহেব অন্তত বলবেন, তার প্রথম কাজ পবিত্র রমজান মাসে জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখা। না, তিনি তা করলেন না। আজব একটা দেশের নাগরিক হয়েছি আমরা যেখানে ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রীর ভাষায়Ñ শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। এতসব সত্ত্বেও ব্যবসায়ীদের প্রতি আকুল আবেদন থাকবে– মানুষকে একটু স্বস্তি দিন অন্তত রমজান মাসে। এই আবেদনের পরেও সরকারকে বলব, অভিজ্ঞতা আমাদের তিক্ত। ‘চোরা’ ব্যবসায়ীরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। অতএব সরবরাহ অফুরন্ত করে বাজার সামলান। ‘ওএমএস’ করুন সর্বব্যাপী।। পণ্যে পণ্যে সয়লাব করে দিন বাজার। বক্তৃতা, অনুরোধ, শান্তির কথা, বৈঠক কিছুই দরকার নেই, কোন এজেন্সিকে দায়িত্ব দেয়ারও দরকার নেই। চিনি, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, ছোলা, বুট ইত্যাদি দ্বারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করুন। মতিঝিলপাড়া, ঢাকা শহরের বড় বড় বাজারের সামনে ‘ওএমএস’ করুন। দেশের বড় বড় শহরেও একই কাজ করুন। বাজারকে বাজার দিয়ে শাসন করুন। বাজেট দিয়ে এই কাজ হবে না। আশা করি, সরকার আমার কথাটা বুঝতে পারবে। যেহেতু নতুন বাজেট সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না; অতএব পুরনো বাজেট, সব বাজেটের সমাহার ষষ্ঠ পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। দেখা যাচ্ছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রায় কোন লক্ষ্যমাত্রাই পূরিত হয়নি। দারিদ্র্য নিরসন, স্কুলে ভর্তি, মাথাপিছু বিদ্যুত ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের পারফরমেন্স ভাল। কিন্তু ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রা মাফিক অর্জিত হয়নি। ষষ্ঠবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির কথা থাকলেও করা যাবে মাত্র ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রা মাফিক ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হবে না। উল্লেখ্য, প্রতিবছর বাজেট হয়। প্রত্যেকটি বাজেটকে একটার সাথে আরেকটাকে যোগ করলে হয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। যদি বার্ষিক বাজেটের টার্গেটও পূরিত না হয় এবং পাঁচ বছর শেষে পরিকল্পিত উন্নয়নের টার্গেটও পূরিত না হয় তাহলে বাজেট ও পরিকল্পনার অর্থ কী দাঁড়ায়? তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, টার্গেট পূরিত না হলেও পাঁচ বছর যাবত গড়ে ছয় শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এটা ভাল ‘পারফরমেন্স’ এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এটুকু স্বীকার করে নিয়ে একটা কথা বলা দরকার। আর সেটা হচ্ছে ৭-৮ শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করতে হলে কোমরে আরও শক্তি দরকার। সেই শক্তির অভাবে আমরা ৬-এর ঘরে আটকে গেছি। আমি জানি না, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে সেই শক্তি অর্জনের কথা এবং বাস্তব পদক্ষেপ আছে কী-না। বাজেট ঘোষণার আগের আলোচনায় কোথাও কয়েকটি বক্তব্য খুঁজে পাইনি। পাইনি যেসব বিষয় সেগুলো হচ্ছে : বৈষম্য হ্রাস করা, আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করার কথা। দিন দিন ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত কয়েকটি পার্টির হাতে। দিন দিন ব্যাংকঋণ সীমিত হচ্ছে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু তার ফসল ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে নিয়ে নিচ্ছে রাঘববোয়ালরা। অতি দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। এসবের আলোচনা বাজেটপূর্ব আলোচনায় খুব বেশি পাইনি। জমি দিলে, গ্যাস দিলে, বিদ্যুত দিলে ব্যবসায়ীরা শিল্প করে ভাসিয়ে দেবেন, লোকের চাকরির ব্যবস্থা করবেনÑএসব বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর যে চাকরিপ্রাপ্তদের হাজার হাজার লোক চাকরিচ্যুত হচ্ছে সেই সম্পর্কে কোন কথা পাওয়া যায়নি। মধ্যবয়সে চাকরি হারানো লোকদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা কী? কোথাও এই আলোচনা পাই না। দেশের উন্নতি হলো, ছেলেমেয়েরা ভয়ে বিয়ে-শাদি করল না সংসার চালাতে পারবে না বলে, তাহলে এই ‘উন্নতির’ অর্থ কী? উন্নতির পর যদি ৫০০ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট না পাওয়া যায় তাহলে উন্নতির অর্থ কী? এসব আলোচনা কোথাও নেই। জানি না, মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এ সবের ব্যাপারে কোন আলোচনা আছে কী-না। উন্নয়ন দরকার, প্রবৃদ্ধি দরকার, প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ দরকার, বিনিয়োগ দরকারÑ এসবই জানা কথা। কিন্তু যে মধ্যবিত্ত বাজারঅর্থনীতির মেরুদ-, বাজারঅর্থনীতির ‘ঠাকুরদা’; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মধ্যবিত্তকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, যার আওতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে সেই মধ্যবিত্তের আয় ঠিক না রেখে বাজেট দিয়ে কী হবে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মধ্যবিত্তের আয় হ্রাস পেয়েছে। ৪-৫ বছর আগে শেয়ার বাজার তার টাকা লুট করেছে। গত দুই-তিন বছরে তার সুদ আয় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ব্যাংক আমানতের সুদ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস পেয়েছে। বিপরীতে ক্রমহ্রাসমান মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে শুরু করেছে। একদিকে আয়হ্রাস এবং অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধি; এই অবস্থায় ৭-৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে এই প্রশ্ন আমার। উচ্চতর প্রবৃদ্ধির অর্থ উচ্চতর চাহিদা। চাহিদা কীভাবে বাড়বে যদি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অবসরভোগী চাকরিজীবী, কর্মজীবী নারীর আয় না বাড়ে, আয় ঠিক না থাকে? নতুন চাকরি হলো দশ হাজারের। চাকরি গেল পনেরো হাজারের। তাহলে বাজার সম্প্রসারণ কীভাবে হবে? এই প্রশ্নটির উত্তর কোথাও পাই না। সরকারকে বলব, এসব ব্যাপারে নজর দিতে। শুধু উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের ফসল ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা করতে। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বৈষম্য, আয় ও খরচের ক্রমবর্ধমান পার্থক্য, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি আর চাকরিচ্যুতির ফারাক ইত্যাদি থাকলে আমরা যে ৬-এর ঘরে আটকা পড়েছি সেখান থেকে বেরোতে পারব না। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা তো পুকুরে সাগরের ঢেউ তুলতে চান, তা তুলুন; কিন্তু সরকারের উচিত বাস্তবতার সঙ্গে বিচরণ করা। নতুন বাজেট হবে, পরিকল্পনা হবে ছয়ের ঘর থেকে বেরোতে পারব না। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×