ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুঃসহ স্মৃতি পেছনে ফেলে তিন কন্যা এখন সুখে আছে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৪ জুন ২০১৫

দুঃসহ স্মৃতি পেছনে ফেলে তিন কন্যা এখন সুখে আছে

শমী চক্রবর্তী ॥ নিমতলী ট্র্যাজেডির সবকিছু হারিয়ে ছিলেন তিন কন্যা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব হারানো তিন জনকে মেয়ে বলে গ্রহণ করেছিলেন। তারা সবাই এখন ভাল আছেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে সবাই সুখী। তিন কন্যার ঘর আলোকিত করে তুলেছে ফুটফুটে শিশু। তিন মেয়ের ঘরে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার নাতি-নাতনী। এদের একজনের নাম আলী মর্তুজা আযান, দ্বিতীয় জনের নাম শ্রদ্ধা, তৃতীয় জনের নাম রমাদান ও চতুর্থ জনের নাম আদর। আলী মর্তুজা আযানের বয়স ৪ বছর। শ্রদ্ধার বয়স ২ বছর ৯ মাস, রমাদানের বয়স চার বছর। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর চতুর্থ নাতি হয়। তার নাম আয়াত হোসেন আদর। এই চার নাতি হলেন নিমতলী ট্রাজেডিতে আপন জন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সেই কন্যাদের সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যারা হলেনÑ উম্মে ফারওয়া আক্তার রুনা, সকিনা আক্তার রতœা ও আসমা আক্তার শান্তা। রাজধানীর নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে আপনজনদের হারিয়েছিলেন রুনা, রতœা ও আসমা। মা-বাবাসহ স্বজন হারানো এই মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার উদ্যোগেই গণভবনে এদের বিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারা এখন শেখ হাসিনার মেয়ে বলেই পরিচিত সবার কাছে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাতের সেই ভয়াবহ ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন পাঁচ বছর ধরে? ওইদিন নিমতলীর ৪৩/১, নবাবকাটরা ৫তলা বাড়িতে সেই ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১২৩ জন প্রাণ হারান। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় কয়েকটি পরিবার। বাড়ির নিচে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লেগে এ ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। রুনার বিয়ের ‘পানচিনি’ অনুষ্ঠানের দিন এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকা-ের পর পরিবার-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া রুনা, রতœা ও শান্তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুকে টেনে নেন। নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে ঘোষণা দেন তারা তার নিজের সন্তান। এরপরই ৯ জুন গণভবনে নিজে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রী তার তিন কন্যার বিয়ে দেন। গতকাল হোসনী দালান রোডে এ তিন কন্যার বাসায় গিয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। চানখারপুলের হোসনী দালান রোডের ১৮/১০, শিয়া গলির বাড়ির দোতলায় থাকেন উম্মে ফারওয়া আক্তার রুমা। চার বছরের ছেলে আযানকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন বলে জানান তিনি। ২০১১ সালের ৫ জুন তার ঘরে এসেছে আলী মর্তুজা আযান। আযান বর্তমানে অগ্রগামী শিশু নিকেতনে প্লে গ্রুপে পড়ে। স্বামী সংসার ও সন্তান নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে কাটে রুনার প্রতিদিন। রুনা বলেন, আযান তো নানির কাছে যাবার জন্য পাগল। কিন্তু কাজের ঝামেলায় চাইলেই যেতে পারি না। গতবার রোজার ঈদের সময় গণভবনে আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আযান নানিকে দেখেই চিৎকার করে ডাকতে থাকে। আযানের এই চিৎকার শুনে মা যখন তাকে কোলে নিলো সে যে কি খুশি। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে সন্তানের স্থান দেয়াতে আমরা আবার নতুন একটা জীবন পেয়েছি। উনার হাত আমাদের মাথায় আছে বলেই আমরা ভাল আছি। মা আমাদের জন্য যা করেছেন তাতে আমরা অনেক ভাল আছি। শুধু আমাদের একটাই চাওয়া তিনি যেভাবে আমাদের মাথায় হাত রেখেছেন সেই হাতটা যেন আমার সন্তানের মাথায়ও রাখেন। আমার এখন সব চাওয়া-পাওয়া একমাত্র ছেলে আযানকে নিয়ে। সে যদি ভালভাবে পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে তাহলেই আমার জীবন সার্থক হবে। ২০১০ সালের ৩ জুনের কথা উল্লেখ করে রুনা বলেন, আমি আজও সেই দিনের কথা ভুলতে পারি না। প্রতি বৃহস্পতিবার এলেই আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বুক ফেটে কান্না আসে। রাতে ঘুমতে গেলে এখনও চোখের সামনে ভেসে আসে সেই ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ। রুনার উকিল বাবা সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোন করে কথা বলেন। তিনি সবসময় তার মায়ের খবর নেন। কোন সমস্যা হলে উনার কাছে জানাতে বলেন। রুনার স্বামী সৈয়দ রাশেদ হোসাইন জামিলকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌ-বাহিনীতে চাকরি দিয়েছেন। শাশুড়ির দেয়া চাকরি পেয়ে আর বিদেশে যাননি তিনি। এখন সবমিলিয়ে ভালই চলছে তাদের সংসার জীবন। প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে সকিনা আক্তার রতœা। স্বামী ও তিন বছর বয়সী মেয়ে শ্রদ্ধাকে নিয়ে এখন তারা নিমতলীতে নিজেদের বাসায় থাকছেন। ভালই আছেন সবাই। গণভবনে বিয়ের পর মায়ের নির্দেশে তার স্বামী সাইদুর রহমান সুমনকে বেসিক ব্যাংকে চাকরি দেয়া হয়। রতœা বলেন, মা আমাদের অনেক বেশি ভালবাসেন। উনার গণভবনে কোন অনুষ্ঠান হলেই তিনি আমাদের যেতে বলেন। এছাড়া প্রতি ঈদে আমাদের সবার সঙ্গে দেখা করেন ও উপহার পাঠান। তিনি আমাদের মায়ের অভাব ভুলিয়ে দিয়েছেন শুধু ভালবাসা দিয়ে। রতœা বলেন, ওই বিভীষিকাময় দিনের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। বাথরুমের কাছে গেলেই মনে পড়ে যায়, বড় খালার লাশ যেভাবে বের করছিলো সেই দৃশ্য। এই সর্বনাশা আগুন আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তখন কেউ আমাদের দেখার মতো ছিল না। মা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে আজ আমরা ভালভাবে বেঁচে আছি। প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় মেয়ে আসমা আক্তার শান্তা পরিবারের ৩৭ জন সদস্যকে হারিয়েছেন ওই অগ্নিকা-ের ঘটনায়। নিজের বেঁচে থাকাটা এখনও অবিশ্বাস্য লাগে আসমার কাছে। তবুও দুই সন্তান ও স্বামীর জন্য নিজেকে সামলে নেন তিনি। আসমা-আলমগীর দম্পতিরও চার বছর আগে ৯ জুন প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে গণভবনে বিয়ে হয়। এখন তারা পুরনো ঢাকার আগা সাদেক লেনের ৯৬/১ নম্বর বাড়িতে থাকেন। বসার ঘরটির দেয়ালে আলোচিত সেই বিয়ের ছবি থরে থরে সাজানো রয়েছে। আসমার স্বামী আলমগীর বর্তমানে সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। আসমার দুই ছেলে আদর ও রামাদান। রামাদান নাম রেখেছেন নানি শেখ হাসিনা। এই তিন কন্যার এখন সবকিছু তাদের মা প্রধানমন্ত্রী। তিনিও তাদের আগলিয়ে রেখেছেন পরম মমতা দিয়ে। সন্তানের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখের খবর নেন সব সময়। আপন মা যেমন জামাই বাড়ি গ্রীষ্মের ফল পাঠান, মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীও তাদের তিন বোনের বাসায় প্রত্যেকবার ফল পাঠান। সরাসরি বছরে একবার দেখা হলেও শত ব্যস্ততায় বিভিন্ন উৎসবে নিয়মিতই খোঁজ নেন তাদের। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা তাদের তিন বোনের উকিল বাবা হাজী সেলিম এমপি, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন। প্রতিবছর ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডিতে নিহত স্মরণে নির্মাণ করা স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান নিহতের পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া তাদের আত্মার শান্তির জন্য মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। এবারও নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য শুক্রবার মিলাদ মাহফিল ও কুলখানির আয়োজন করেছে।
×