ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিমতলী ট্র্যাজেডি ॥ পাঁচ বছরেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি কেমিক্যাল গুদাম

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৪ জুন ২০১৫

নিমতলী ট্র্যাজেডি ॥ পাঁচ বছরেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি কেমিক্যাল গুদাম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ স্মরণকালের ভয়াবহ নিমতলী ট্র্যাজেডি দিবসের পাঁচ বছর পরেও পুরনো ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম পুরোপুরি সরেনি। যে কারণে আতঙ্কও সরে যায়নি পুরনো ঢাকাবাসীর মন থেকে। আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। কেমিক্যালের গুদাম থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিমতলী, নবাবকাটরা, আগামসী লেনসহ পুরনো ঢাকার অনেক বাসিন্দাই। গুদাম না সরার নেপথ্য কারণ বাড়ি ভাড়া। ভাড়াটিয়াদের চেয়ে তিনগুণ বেশি ভাড়া পাওয়া যায় কেমিক্যালের গুদাম থেকে। এজন্য কেমিক্যালের গুদাম সরানো কঠিন বলে স্থানীয়দের দাবি। উচ্চ আদালতের তরফ থেকেও দ্রুত পুরনো ঢাকা থেকে সব কেমিক্যালের গুদাম সরানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবার নিমতলীর মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া, মিলাদ মাহফিল, গরীব দুঃখীদের মাঝে খাবার বিতরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে। নিমতলী ট্রাজেডি স্মরণে নির্মিত ‘ছায়া স্মৃতিস্তম্ভে’ হতাহতদের পরিবার, স্থানীয় সংসদ সদস্য, মেয়র, ওয়ার্ড কমিশনার ও কাউন্সিলরসহ সমাজের বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের তরফ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। কেমিক্যালের গুদামের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যেই পুরনো ঢাকা থেকে প্রায় সব কেমিক্যালের গুদাম সরে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। নতুন করে পুরনো ঢাকায় গুদাম স্থাপন করে কাউকে কেমিক্যাল ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কেমিক্যালের গুদাম শনাক্ত করে তা সরানোর কাজ চলছে। কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক ইন্ড্রাস্টিজের জন্য ঢাকার কেরাণীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। দ্রুত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা সম্ভব হলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই কেমিক্যালের গুদাম ও প্লাস্টিক শিল্প প্রতিষ্ঠান সরে যাবে। পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগলে তার ভয়াবহ পরিণতি ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরফ থেকে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। ২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরনো ঢাকার নবাবকাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত নয়টার দিকে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় ছয়তলা বাড়িটির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্মা এবং পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনেরা পার্লারে সাজছিল। আর বাড়ির নিচতলায় রান্না চলছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচ- তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিকের ড্রাম গলে যায়। এরপর দ্রুত কেমিক্যালে আগুন ধরে যায়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে দরজা জানালা ভেঙ্গে পড়ে। আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভার মতো পুরো এলাকায় কেমিক্যাল ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই নিচ তলায় থাকা একই পরিবারের এগারো জনের মৃত্যু হয়। আর সামনের ৫৫ নম্বর বাড়ির ৬ জন এবং বিয়ের বাড়ি লাগোয়া বাড়ির আর ছয়জনের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পরে তিন কন্যাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃস্নেহে গণভবনে নিয়ে বিয়ের আয়োজন করেন। তিন মেয়ের স্বামীকে চাকরী দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তিন কন্যাকে থাকার সুব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, গহনাসহ যাবতীয় সবকিছু দেন। আজও প্রধানমন্ত্রী তাদের খবর রাখেন বলে আসমা, রুনা ও রতœা জানান। ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর পুরনো ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম সরানোর কড়া নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরই শুরু হয় তৎপরতা। ভ্রাম্যমাণ আদালত পুরনো ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে প্রায়ই হানা দিয়ে কেমিক্যালের গুদাম শনাক্ত করতে থাকে। তাদের জেল জরিমানাসহ গুদাম অন্যত্র সরাতে বাধ্য করা হয়। ঘটনার পর থেকেই এমন তৎপরতা অব্যাহত আছে। নিমতলী ট্রাজেডি স্মরণে নির্মিত ছায়া স্মৃতিস্তম্ভে বসে কথা হয় ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির বাসিন্দা হাজী আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরনো ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদাম পুরোপুরি সরে যায়নি। তবে আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে নবাবকাটরায় কেমিক্যালের গুদামের পরিমাণ আগের তুলনা অনেক কম। স্থানীয় জনতার প্রতিরোধের মুখে এখন আর কোন বাড়িওয়ালা কেমিক্যালের গুদাম হিসেবে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না। যদিও অনেকেই গোপনে কেমিক্যাল গুদাম হিসেবে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে। এমন বাড়ির মালিকের সংখ্যাও কম। নিমতলী ট্রাজেডিতে নিহত সাত বছর বয়সী বৈশাখের পিতা ফল ব্যবসায়ী মামুন মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনার সময় আমার ছেলে দোকানে ঘুমিয়েছিল। গরম কেমিক্যাল আমার ছেলেকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। আমি তখন দোকানের বাইরে ছিলাম। দৌড়ে দোকানের কাছে গিয়ে ছটফট করতে করতে আমার ছেলেকে মরতে দেখেছি। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। কারণ যেই বাঁচাতে যাবে, সেই মরবে। মামুন মিয়ার দাবি, নবাবকাটরা এলাকায় কেমিক্যালের গুদাম কমে গেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। এখনও নবাবকাটরা, আগামসী লেন, নাজিরাবাজার, মিডফোর্ড, কায়েতটুলীসহ আশপাশের অনেক বাড়িতে গোপনে কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে। তবে আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এটি সত্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরনো ঢাকার বিভিন্ন মহল্লার বাড়িতে কেমিক্যালের গুদাম থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে আগের তুলনায় অনেক কম। এখনও অনেক বাড়িতেই কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে। কেমিক্যালের গুদাম না সরার অন্যতম কারণ বাড়িভাড়া। কারণ যে ফ্ল্যাটটি কোন ভাড়াটিয়ার কাছে হয়তো দশ হাজার টাকায় ভাড়া দেয়া সম্ভব, সেই ফ্ল্যাটটিই কেমিক্যাল গুদাম হিসেবে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় ভাড়া দেয়া সম্ভব। এজন্য অনেক বাড়ির মালিক বাড়তি টাকার আশায় গোপনে ফ্ল্যাট বা কক্ষ ভাড়াটিয়াদের কাছে ভাড়া না দিয়ে, কেমিক্যালের গুদাম হিসেবে ভাড়া দিচ্ছেন।
×