ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির সফরে ১৯ চুক্তি হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৪ জুন ২০১৫

মোদির সফরে ১৯ চুক্তি হতে পারে

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১৯টি চুক্তির প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সফর ঘনিয়ে এলেও এখনও দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি চলছে। এছাড়া এবারের ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না হলেও এ বিষয়ে জট ছাড়াতে মোদি বদ্ধপরিকর। আর ঢাকা সফরের সময় সীমান্তে অনুপ্রবেশ নিয়ে আলোচনার জন্য মোদির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর সামনে রেখে ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে প্রথমে ১০টি চুক্তির বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। তবে দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রগতি হওয়ায় দু’পক্ষ আরও বেশ কয়েকটি চুক্তি করতে আগ্রহী হয়েছে। সে কারণে চুক্তির পরিধি বাড়ছে। এখন দুই দেশ প্রায় ১৯টি চুক্তির প্রস্ততি নিয়েছে। এখনও বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দরকষাকষি চলছে। উভয়পক্ষই ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এসব চুক্তি করতে চাইছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা আসার আগে চীন সফরে গিয়েছিলেন। সে সময় চীনের সঙ্গে ভারতের ২৪টি চুক্তি হয়। তার আগে গত এপ্রিল মাসে মোদি ফ্রান্স সফরে যান। ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয় ১৭টি। আর প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় অনেক বিষয় রয়েছে। সে কারণে ঢাকা-দিল্লী প্রাথমিকভাবে ১০টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন করতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তির জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তির জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑ কলকাতা-ঢাকা-আগরতলার মধ্যে সরাসরি বাসসেবা চালু, ঢাকা-শিলং বাসসেবা চালু, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি ও নবায়ন, নৌ ট্রানজিট প্রটোকলের মেয়াদ বৃদ্ধি ও নবায়ন, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, মানবপাচার বিষয়ে চুক্তি, বিদ্যুত সহযোগিতা চুক্তি, নতুন ঋণ চুক্তি, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অঞ্চল সমঝোতা চুক্তি, পণ্য রফতানিতে দু’দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে চুক্তি, কোস্টগার্ডকে শক্তিশালীকরণ বিষয়ে চুক্তি, ভারতে ব্যান্ডউইডথ বিক্রি, সন্ত্রাস দমন বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি ইত্যাদি। তবে এখনও বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সামরিক যন্ত্রপাতি যৌথভাবে উৎপাদন, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবেলা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মোদির আসন্ন ঢাকা সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিদ্যমান চুক্তির নবায়ন হবে। আবার কয়েকটি বিদ্যমান চুক্তির সংশোধনী ও নবায়ন হবে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তির নবায়ন হবে। আবার নৌ প্রটোকল চুক্তির সংশোধনীসহ নবায়ন হবে। তবে সামরিক যন্ত্রপাতি যৌথভাবে উৎপাদন, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সহায়তা, দুর্যোগ মোকাবেলা ইত্যাদি বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে এখনও আলোচনা চলছে। এদিকে জানা গেছে, দীর্ঘ তিন বছর আলোচনা শেষে এবার ভারতে ব্যান্ডউইডথ রফতানির বিষয়টি চূড়ান্ত হতে চলেছে। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যান্ডউইডথ রফতানি করে প্রতি বছর ১০০ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। দেশে বর্তমানে ২০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ আছে। এরমধ্যে মাত্র ৩০ জিবিপিএস বাংলাদেশ ব্যবহার করে। বাকি ১৭০ জিবিপিএস ব্যবহার হয় না। এই অব্যবহৃত ব্যান্ডউইডথ থেকেই মাত্র ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ রফতানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চুক্তির মেয়াদকাল হবে তিন বছর। এছাড়া প্রথম তিন বছরের চুক্তির পর প্রতি বছর চুক্তি নবায়ন করা হবে। তিস্তা জট ছাড়াতে মোদি বদ্ধপরিকর ॥ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর অবস্থানকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে ভারত। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারও দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী। তাই এ সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় স্থলসীমান্ত চুক্তি সই হচ্ছে। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আপাতত না হলেও এ বিষয়ে সব জট ছাড়ানোর বিষয়ে যে মোদি বদ্ধপরিকর, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। বুধবার ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তিও পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বিরোধিতার মুখে পড়েছিল। অসমে মোদির দল বিজেপিই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তবে সব অসন্তোষ ও বিরোধিতাকে সামলে শেষ পর্যন্ত মোদি এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান সম্পর্কেও বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, মমতা এই সফরেই তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করে তাতে সই করতে রাজি হননি। তবে মমতা কখনই বলেননি তিনি এই চুক্তির বিরুদ্ধে। তার বক্তব্য, একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার কাছে প্রধান অগ্রাধিকার হলো রাজ্যের স্বার্থ। তিস্তা চুক্তি এমনভাবে করতে হবে যাতে উত্তরবঙ্গ পানি থেকে বঞ্চিত না হয়। তিস্তা সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে। পানির অভাবে সিকিম আটটি হাইড্রোলিক বাঁধ নির্মাণ করেছে। মমতার বক্তব্য, এই বাঁধগুলোর ফলে উত্তরবঙ্গে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক আগে মোদিকে মেটাতে হবে। কারণ সিকিম সরকার পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে যে, পানি সঞ্চয় করে তারা বাঁধ নির্মাণ করেনি, স্রোতকে অবরুদ্ধ না করেই তা থেকে পানি নিয়ে বাঁধের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আনন্দবাজারে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে তিস্তা প্রবল আবেগতড়িত বিষয়। অনেকে বলছেন, দু’দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক চুক্তি রূপায়ণের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু সেটা যেমন সত্য, তেমন এটাও সত্য যে, কোন দেশের পক্ষেই অভ্যন্তরীণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজ্যের মতামতকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তবে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কর্মপদ্ধতিতে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। মনমোহন যা পারেননি সেটা মোদি পেরেছেন। মোদি মমতাকে বোঝাতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা বিশেষ প্রয়োজন। অসম নিয়ে আলোচনার অনুরোধ ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে অসম প্রসঙ্গে আলোচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ মোদির প্রতি এই অনুরোধ করেন। মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে গগৈ বলেন, মোদির উচিত বাংলাদেশ ও অসমের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা। বাংলাদেশ ও অসমের মধ্যে পানি সরবরাহ, বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতার দিকে অধিক জোর দেয়া উচিত বলে মনে করেন গগৈ। তিনি আরও বলেন, যেহেতু ভৌগলিক সীমারেখার দিক থেকে অসম ও বাংলাদেশের দূরত্ব সবচেয়ে কম, এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ও চুক্তি হলে উভয় দেশ লাভবান হতে পারে। মোদির প্রতি গগৈ সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানাতে অনুরোধ করেছেন। এছাড়া বাংলাদেশে অসমের অনুপ্রবেশকারী বা অসমে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার প্রসঙ্গটিও উত্থাপনের দাবি জানান গগৈ। উল্লেখ্য, আগামী ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসছেন। এই সফর ঘিরে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এই সফরে মোদির সঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্ত রাজ্যের পাঁচ মুখ্যমন্ত্রীও ঢাকায় আসছেন।
×