ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে;###;মধ্যবিত্তের জন্য স্বস্তির পদক্ষেপ

৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ক্লাবে প্রবেশের প্রত্যাশা ॥ আজ বাজেট

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৪ জুন ২০১৫

৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ক্লাবে প্রবেশের প্রত্যাশা ॥ আজ বাজেট

কাওসার রহমান ॥ অর্থনীতির উড়ানের জন্য সাহসী ‘টেক-অফের’ দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই বিমান চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। অর্থনীতির সেই বিমান এখন রানওয়ের শেষপ্রান্তে। মুহিত কি পারবেন বিমানের সাহসী টেক-অফ নিতে? নাকি কিছু ‘চমক’ দেখিয়ে যেনতেন টেক-অফ করেই দেশবাসীকে সন্তুষ্ট করতে চাইবেন? গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের প্রবৃদ্ধি আটকে আছে ছয় শতাংশের বেড়াজালে। প্রতিবছর বড় প্রত্যাশা জাগিয়েও শেষপর্যন্ত তা আর সাত শতাংশের কক্ষপথে ঢুকতে পারছে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতির এ ‘এলিট ক্লাবে’ ঢুকতে অর্থমন্ত্রী এবার সেই প্রত্যাশার লোভ বহুকষ্টে সংবরণ করেছেন। বার বার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে তা অর্জন করতে না পারার বাস্তবতার আলোকে এবার নতুন বছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। সুন্দরবনে তন্নতন্ন করে সেই ‘সোনার হরিণ’ খুঁজতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেই আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন বাজেট দিতে যাচ্ছেন। সীমিত সম্পদের এ দেশে বাজেট দিয়ে সকল পক্ষের মন পাওয়া খুব কষ্টকর। তারপরও অর্থমন্ত্রীর চেষ্টা থাকে দেশের মধ্যবিত্ত ও শিল্প মহলকে খুশি করার। অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবমতো অর্থমন্ত্রী যদি এখনই ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে পারতেন তাহলে হয়ত সকল পক্ষকে খুশি করতে পারতেন। বাস্তবতা তো অনেক ভিন্ন। অর্থনীতি সমিতিকে তো আর বাজেটের টাকা যোগাড় করতে হবে না, তাই তাদের প্রস্তাব দিতে সমস্যা কী? তবে অর্থমন্ত্রীর সমস্যা অনেক। তাকে যেমন স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব মোকাবেলা করতে হয়, তেমনি খুশি রাখতে হয় দেশের সবচেয়ে শক্তিধর ভোক্তা মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে। আবার নজর থাকে শিল্প মহলের প্রতি তারা যেন কোন কারণে মনক্ষুণ না হয়। কারণ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি তাদেরই হাতে। এ মুহূর্তে অর্থনীতিকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার বেসরকারী লগ্নির ‘ইঞ্জিন’। দেশের সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির পথে একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ বেসরকারী বিনিয়োগ। দেশে এই বিনিয়োগ টেনে আনার জন্য বাজেটে প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণে কর ছাড়ের মতো উৎসাহবর্ধক দাওয়াই। বেসরকারী লগ্নির জন্য দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় মঞ্চই এখন তৈরি। অশোধিত তেলের দামে এখন কমতি, নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রবৃদ্ধির মূল শক্র মূল্যস্ফীতি। আমদানি খরচ কমে গিয়ে বিদেশী মুদ্রার ভা-ারও ফুলে ফেপে উঠেছে। ব্যাংকের সুদের হারও এখন কমতে শুরু করেছে। ফলে দেশে এখন বেসরকারী বিনিয়োগের অনুকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা ও মতামত গ্রহণের মাধ্যমেই অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে নতুন বাজেটের একটি কাঠামো তৈরি করেছেন। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি, মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো ও দারিদ্র্যের হার কমাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কৌশল নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এজন্য মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের গত ৬ বছরের বৃত্ত ভেঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জের পথে যাত্রার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, যা অর্থনীতির উড়ালে সাহসী টেক-অফেরই ইঙ্গিত বহন করছে। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদের ৫ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরেও প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘর অতিক্রম করতে পারেনি। প্রবৃদ্ধির হারের গত দীর্ঘ সময়ের বৃত্ত ভেঙ্গে আগামী অর্থবছরে ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। এ লক্ষ্য যাতে অর্জিত হয় সেজন্য সব ধরনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনাও মন্ত্রণালয়গুলোতে ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার গতানুগতিক বাজেটের কাঠামো থেকেও বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। বিশাল অংকের বাজেট দিয়ে সরকার চাইছে, সরকারী-বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, পিপিপিকে আরও কার্যকর করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর পূর্ণ বাস্তবায়ন। কারণ চার বছর ধরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হলেও বাস্তবে ৬ শতাংশের ছকেই রয়েছে। নতুন বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে। পাশাপাশি আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছর নাগাদ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এই প্রথম কোন অর্থমন্ত্রী উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি রোডম্যাপ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন বাজেটে। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। আগামী ২০১৯-২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময় শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখাতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে তিনি একটি রূপরেখাও তৈরি করেছেন। এই রূপরেখায় বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকারী বিনিয়োগে বিদ্যুত, জ্বালানি, শিক্ষা, পরিবহন, যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর পূর্ণ বাস্তবায়ন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর, শ্রমশক্তির দক্ষ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর অংশগ্রহণ, বহির্বাজার সম্প্রসারণ, গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের কথা থাকছে। নতুন বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ছে প্রায় পৌনে ১৮ শতাংশ। তবে অর্থমন্ত্রী বলছেন, আগামী বাজেটের আকার হবে ৩ লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি। বাজেটের আকার যাই হোক না কেন, বিশাল এ ব্যয় মেটাতে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রাজস্ব আদায় করতে সরকারকে করের জাল আরও বাড়াতে হচ্ছে।
×