ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বাজেট হচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২ জুন ২০১৫

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বাজেট হচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

কাওসার রহমান ॥ বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দেশ চালানোর দিন শেষ। এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বার্ষিয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে সে কাজ আগেই শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাহস করে নিজ অর্থেই শুরু করেছেন পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। শুধু এ পদ্মা সেতুই নয়, দেশের সব উন্নয়ন দেশের অর্থেই করতে হবে। এজন্য বাড়াতে হবে অভ্যন্তরীণ অর্থ সংগ্রহ। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে। তাহলেও বিদেশীরাও সমীহ করে কথা বলবে। তাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বাজেটই এবার দিতে যাচ্ছেন শেখ হাসিনার সরকার। আগামী ৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন তার মাধ্যমেই বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করবে। এ লক্ষ্যে বাজেট তৈরিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বাজেট প্রণেতাদের। বাজেট নিয়ে একাধিকবার গণভবনে বৈঠক করেছেন। এ কারণেই আগামী অর্থবছরে টাকা খরচের চেয়ে অর্থ সংগ্রহের দিকেই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ৩০ শতাংশ বেশি লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়কারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। আর এ রাজস্ব আদায় করতে চারদিকেই হাত সম্প্রসারণ করতে যাচ্ছে এনবিআর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের প্রধান তিন হাতিয়ার হচ্ছে- আয়কর, মূল্যসংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক। আগামী অর্থবছরে এই তিন হাতিয়ারকে কোরবানির ঈদের আগে দা-ছুরি শাণ দেয়ার মতো শাণিত করে মাঠে নামছে রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটি। শুধু করের আওতা সম্প্রসারণই নয়, নতুন নতুন অনেক পণ্যেই বসছে কর। বিশেষ করে স্পর্শকাতর পণ্য বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বলে এক সময় যে সকল পণ্যকে করের আওতা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, সেগুলোর ওপরও নতুন করে কর বসানো হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কই ছিল এক সময় রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত। বাণিজ্য উদারীকরণের কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে এখাতে রাজস্ব আদায় কমতে থাকে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায়ের নতুন হাতিয়ার হিসাবে রাজস্ব বোর্ড চালু করে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। ক্রমান্বয়ে এই পরোক্ষ করটিই দেশে রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাতে পরিণত হয়। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত এ খাতই ছিল দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস হচ্ছে আয়কর। কেবল আমাদের দেশেই এর ব্যতিক্রম। তবে গত কয়েক বছর ধরেই শেখ হাসিনা সরকার পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর অর্থাৎ আয়করের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরেও ভ্যাটের চেয়ে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত চলতি অর্থবছরও ভ্যাটই রাজস্ব আদায়ের শীর্ষে থাকবে বলে পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পথে অর্থমন্ত্রী এবার আয়কর আদায়ের প্রতিই বেশি জোর দিচ্ছেন। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এক স্বাবলম্বী দেশ গড়ার জন্য এই প্রথম আয়করকে রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎসে পরিণত করার সর্বাত্মক প্রদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কারণ নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে নিজেদেরই কর দিতে হবে। যে সকল দেশ আজ উন্নতির সোপানে উন্নীত হয়েছে তারা নিজেদের কর দিয়েই উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। শেখ হাসিনার সরকার আগামী অর্থবছরে সে পথেই হাঁটতে যাচ্ছে। ফলে আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছর আয়কর থেকে ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর। এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। আর শুল্ক থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। যা চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। এই বিশাল লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উৎসে আয়করের প্রতিই সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। এটি কর আদায়ের একটি সহজ পন্থা। যা আগাম কেটে নিয়ে পরে করের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। প্রতিবছর আয়কর খাতে যে রাজস্ব আদায় হয় তার ৬০ ভাগই আসে উৎসে আয়কর থেকে। তাই আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে আওতা বাড়াতেই সরকার সম্ভাব্য এলাকায় উৎসে আয়কর প্রসারিত করতে যাচ্ছে। এ জন্য এই কর আদায়ের খাত বাড়ানোসহ বিভিন্ন খাতে করহার পুনর্নির্ধারণ হতে পারে। বর্তমানে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন দশমিক ০৫ শতাংশ হারে খাতভিত্তিক উৎসে কর আদায় করা হয়। আগামী অর্থবছরে উৎসে কর হার পুনর্নির্ধারণের পাশাপাশি আরও ৮টি খাত যুক্ত করে সর্বমোট ৬০ খাত থেকে উৎসে কর আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব খাতে উৎসে কর বাড়ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সিকিউরিটিজের সুদ আয়, ঠিকাদার বিল, চিকিৎসকদের ফি, রয়েলটি ফি, সিগারেটের ব্যান্ডরোল, ইটপ্রস্তুতকারক, গৃহসম্পত্তি আয় প্রভৃতি। এতোদিন চাল, আটা, ময়দা, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কোন প্রকার কর ছিল না। আগামী অর্থবছরে এসব পণ্য আমদানির ওপর ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বসানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আগামী বাজেটে গম, ভুট্টা বীজ, পরিশোধিত সূর্যমুখী তেল, এমএস রড, মডেম এবং মোবাইল ও টেলিফোন ওয়্যারলেস সেটেও এই অগ্রিম আয়কর বসানো হচ্ছে। নতুন বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রাতিষ্ঠানিক সব প্রাইভেট গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস নবায়নকালে অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর দেয়ার বিধান থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক গাড়ির ওপর অগ্রিম আয়কর নেই। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যক্তিগত গাড়ির মতো প্রাতিষ্ঠানিক গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস নবায়নকালে অগ্রিম আয়কর দিতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে ৩৫০টি বিশেষ আইটেম ছাড়া বাকি সব পণ্য আমদানিতেই ৫ শতাংশ আগ্রিম আয়কর আরোপ করা আছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে আগামী বাজেটে তাই অব্যাহতি পাওয়া পণ্যের তালিকা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য কাস্টমস আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। তৈরি পোশাক রফতানিতেই এবার উৎসে আয়কর বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক রফতানি আয়ের উৎসে করহার দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লেও বাড়ছে ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ। এটা ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা এবং ব্যক্তি-শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর থেকে কোন ব্যক্তির বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকার বেশি হলেই তাকে ৪ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। একইসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ানো হবে মহিলা, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়ের সীমা। তবে সিনিয়র সিটিজেনদের কর অব্যাহতি দেয়া হতে পারে। সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক গাড়ির ওপর কর আরোপ, মূল বেতনের পাশাপাশি সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতা-বোনাসও করের আওতায় আসছে। এতদিন শুধু বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে পুরো বেতনের ওপর কর আদায় করা হতো। অপরদিকে সরকারী কর্মকর্তারা মূল বেতনের ওপর কর দিতেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কর্মচারীরাও করের আওতায় আসবেন। বর্তমানে ১৩ লাখ সরকারী কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। এদের মধ্যে ৫০ হাজার কর্মকর্তা আয়কর রিটার্ন জমা দেন। বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ী মহল থেকে জোর আপত্তি তোলায় সারচার্জের স্তর পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে। ২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে সারচার্জের সীমা আড়াই কোটি করা হতে পারে। এ ছাড়া সারচার্জের হারেও পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে জমি বা সম্পত্তির দলিল মূল্যের ওপর সারচার্জ আদায় করা হয়। দীর্ঘদিন পর কর্পোরেট কর হার কমানো হচ্ছে। গড়ে কর্পোরেট কর হার আড়াই শতাংশ হ্রাস করা হচ্ছে। তবে বহুল আলোচিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আগামী অর্থবছরেও বহাল থাকছে। বর্তমানে একটি স্থায়ী নিয়ম আছে, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর জরিমানা দিয়ে কালো টাকা যেকোন খাতে বিনিয়োগ করা যাবে। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। এছাড়া পুঁজি বাজারকেও আগামী বছর কিছু কর ছাড় দেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর আদায় থেকে ছাড় পাচ্ছে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন বাজেটে এ ছাড় দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পুঁজিবাজারে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ করমুক্ত। এটি বাড়িয়ে ৩০ হাজার করা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে করের আওতা বাড়াতে দেশের প্রতিটি উপজেলায় কর অফিস স্থাপন করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। রাজস্ব আদায়ে বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর আদায়ে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন কর অফিস স্থাপনের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কর প্রদানে সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে করের আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দিক নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব উপজেলায় কর অফিস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন।
×