ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশের শিক্ষায় আরও ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ কৈলাস সত্যার্থীর

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১ জুন ২০১৫

বাংলাদেশের শিক্ষায় আরও ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ কৈলাস সত্যার্থীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে আরও ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ঢাকা সফররত ভারতীয় সমাজ ও মানবাধিকারকর্মী কৈলাস সত্যার্থী। তিনি বলেছেন, শিক্ষা সকলের জন্মগত অধিকার। দেশের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে ব্যয় করলে এর রিটার্ন অনেক বেশি। বাজেটে শিক্ষা খাতে ও তরুণদের জন্য ব্যয় বাড়ানো উচিত। শিক্ষা খাতে ১ ডলার ব্যয় করলে ২০ বছর পর ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রিগতির প্রশংসা করে সত্যার্থী বললেন, বাংলাদেশকে দেখে আমি মুগ্ধ হই। দারিদ্র্যসহ অন্যান্য সমস্যা যেভাবে দেশটি কাটিয়ে উঠেছে তা আমাকে উৎসাহিত করে। এ দেশের তরুণরা অনেক এ্যাকটিভ, ডায়নামিক। ঢাকা সফররত ভারতীয় এ নোবেলজয়ী মানবাধিকারকর্মী রবিবার রাজধানীতে পৃথক পৃথক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নিয়ে এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। সকালে প্রথমে তিনি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। এ সময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী তার সঙ্গে ছিলেন। সাক্ষাত শষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কৈলাস সত্যার্থী বলেন, দেশের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ালে সেটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ রাখা হয় তা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ- সাংবাদিকদের এমন তথ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা খাতে ব্যয় করলে এর রিটার্ন অনেক বেশি। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছি আমরা। প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অতি দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার কমিয়ে আনা এ সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হয়েছে এবং ভাল করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা এবং শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি গভীর আগ্রহ প্রকাশ করায় কৈলাস সত্যার্থীকে ধন্যবাদ জানান উপাচার্য। সাক্ষাতকালে তারা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নসহ সমাজকে সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও অসৎ কর্মকাণ্ড কিভাবে মুক্ত করা যায় এ বিষয়ে আলোচনা করেন। সবশেষে রাজধানীর এলজিইডি ভবনের মিলনায়তনে শিক্ষার অধিকার বিষয়ে জাতীয় সম্মেলনে যোগদেন ভারতীয় এ নোবেলজয়ী। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। উপস্থিত ছিলেন পল্লী কর্মী সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল আলম, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেশের শিক্ষাখাতে উন্নয়নে বেসরকারী বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শুধু সরকারী অর্থে শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার বহন সম্ভব নয়। এটি শুধু আমাদের মতো দেশের নয়, উন্নত দেশের জন্যও প্রযোজ্য। তাই বেসরকারী খাতেও শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে শিক্ষাখাতে যখনই বেসরকারী বিনিয়োগ আসে, তখন তারা এটাকে লাভের জায়গা হিসেবে ধরে নেন। এই মনোভাব বাদ দিতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে অবদান রাখার অংশ হিসেবে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হব। মন্ত্রী আরও বলেন, ৬ বছর আগে যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন শতকরা ৯ জন শিশু স্কুলের বারান্দায় উঠত না। ৪৮ ভাগ ৫ম শ্রেণীর আগেই ঝরে পড়ত। ৯ম শ্রেণীতে ওঠার আগে স্কুলে আসা বন্ধ হত শতকরা ৮২ জন শিক্ষার্থীর। এখন শতকরা ৯০ জনের নামই স্কুলে লেখাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। তবে ঝরে পড়া এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রেও আমরা সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করছি। সকল শিশুকে আমরা প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দিতে সক্ষম হচ্ছি। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষা বাতিলের দাবি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা হচ্ছে অস্থায়ী একটা ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েদের স্কুলে আকৃষ্ট করার জন্যই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া প্রাথমিকে আমরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জেন্ডার বিষয়ে সমতা আনতে পেরেছি। আগামী ৩ থেকে ৫ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও এই সমতা অর্জন করতে সক্ষম হব। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রেও শিক্ষার সমান সুযোগ রাখা হচ্ছে। তবে তাদের সঠিক সংখ্যা না জানার ফলে বই ছাপতে সমস্যা হচ্ছে। অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের জন্যও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করে নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থী বলেন, আমি এবারই প্রথম বাংলাদেশে আসিনি। ৩০ বছর আগে প্রথম এ দেশে এসেছিলাম, তখন আজকের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেরই জন্ম হয়নি। তাই এ প্রজন্মের বাংলাদেশীরা আমার সস্তানের মতো। আমি তাদের সন্তানের মতোই ভালবাসি। বাংলাদেশকে দেখে আমি মুগ্ধ হই। দারিদ্র্যসহ অন্যান্য সমস্যা যেভাবে দেশটি কাটিয়ে উঠেছে তা আমাকে উৎসাহিত করে। এ দেশের তরুণরা অনেক এ্যাকটিভ, ডায়নামিক। তিনি আরও বলেন, শিক্ষা সমাজের বহুমুখী বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাইট টু এডুকেশন আসলে শিক্ষার গ্যারান্টি প্রদান। অন্তত ১৬ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। তবে অবশ্যই সে শিক্ষা হতে হবে কোয়ালিটিসম্পন্ন। বাল্যবিয়ের বিষয়ে এ নোবেল বিজয়ী বলেন, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়ই বাল্যবিয়ে একটি সমস্যা। বাংলাদেশেও যার প্রভাব রয়েছে। আমি ১৮ বছরের উর্ধে বিয়ের ব্যাপারে আমার সমর্থন ব্যক্ত করলাম। এরপর তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তিনি বিশ্বে বাংলাদেশকে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দেশে রূপান্তরিত করতে দক্ষতার সঙ্গে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন। এটি একটি ছোট বিষয় কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি আশা করছি তিনি সামাজিক বিষয়েও গুরুত্ব প্রদান করবেন, যাতে করে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হবে। আর অবশ্যই প্রতিটি শিশুকে শিক্ষা প্রদান করতে হবে, কাউকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কৈলাস সত্যার্থী বলেন, শিক্ষায় বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে শিক্ষায় অর্থায়নকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় উন্মাদনাও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর যখন এর সঙ্গে তরুণরা জড়িয়ে পড়ে তখন তাকে আরও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি নতুন চিন্তার উদ্ভাবন ঘটাতে হবে, যা একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব। বলেন, শিক্ষায় উন্নতি ছাড়া বাংলাদেশের ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য যথাযথ কারিকুলাম, কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, অর্থায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, সব ধরনের বিভাগের মধ্যে আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় ঘটাতে হবে। কারণ শিক্ষার লক্ষ্যপূরণে যেমন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত তেমনি পরিবেশ নিশ্চিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও ভূমিকা থাকে। আমাদের সমতার দিকেও জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি ছাড়া সমতা অর্জন কঠিন। তাই কেবল শিক্ষা নয়, সামাজিক সবক্ষেত্রেই সমতা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি শিক্ষায় নৈতিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
×