ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদ- পুনর্বিবেচনা করা হোক

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১ জুন ২০১৫

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদ- পুনর্বিবেচনা করা হোক

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের সমাজের সর্বত্রই যেন ধর্ষণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে নরপশু ধর্ষকরা। নিত্য ঘটে যাওয়া ধর্ষণের খবর বাসি না হতেই ঘটে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসব পৈশাচিক ঘটনা। রাজধানী ঢাকায় মাইক্রোবাসে গারো তরুণীর নারকীয় নির্যাতনের ঘটনার রাত না পোহাতেই আবারও বুধবার (২৭ মে) শীতলক্ষ্যার বুকে নৌকায় ঘটল সেই একই কায়দায় পাশবিক ঘটনা। এ ঘটনাতেও জড়িত ছিল চার নরপশু। ধর্ষণ যেন সমাজে এক ভয়ঙ্কর দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কিছুতেই যেন রোধ করা যাচ্ছে না এর বিস্তার। অবোধ বালিকা থেকে যে কোন বয়সের নারী আজ ঘরে-বাইরে সবখানেই অনিরাপদ (শুধু তাই নয়, নারীর পাশাপাশি শিশু-কিশোর বয়সী ছাত্ররাও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাতে প্রায়ই ধর্মীয় লেবাসধারী শিক্ষকদের দ্বারা হচ্ছে বলাৎকারের শিকার)। যে সমাজে একজন নারী নিরাপদ নয়, তার শরীর যেখানে মানুষরূপী লোলুপ হায়েনার লালসার শিকার হয় প্রতিনিয়ত প্রকাশ্য জনপদে, সেই সমাজে তখন সভ্যতা পরিমাপের ন্যূনতম মানদ- আর অবশিষ্ট থাকে না। সভ্য সমাজ বলে তার আর দাবি করারও কোন সুযোগ ও অধিকার থাকতে পারে না। অথচ আমাদের হায়েনাকবলিত সেই সমাজকেই উন্নত ও সভ্যতার শিখরে নিয়ে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় রত নেতৃত্বের চূড়ায় বসে আছেন নারী। সহযাত্রীরাও পোড় খাওয়া সংগ্রামী নারী। কী লজ্জার কথা! তবুও প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। দেশের নারী সমাজের সম্ভ্রম ও সম্মান রক্ষায় ব্যর্থতা আর নিজেদের সুরক্ষিত রাখার মধ্যে অমোচনীয় গ্লানি ছাড়া সম্মানের কিছু নেই। এটা বুঝতে হবে রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের। ধর্ষণ কেবল একজন নারীর চরম অবমাননাই নয়, অনেক সময় তা তার মৃত্যুরই নামান্তর। ধর্ষণের শিকার নারী সারাজীবন এক অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণার ভেতরে থাকেন। শিশু ধর্ষণের বিষয়টি আরও মারাত্মক। অত্যন্ত গর্হিত এ অপরাধের শিকার শিশুর মনোজগত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশের স্বাভাবিক ধারাটি নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার জীবনবোধের জগতটাকে আছন্ন করে রাখে এক দানবীয় কুৎসিত ছায়া। ধর্ষিত নারী আমাদের সমাজের কারও মা, কারও বোন। ঘটনাক্রমে কখনও এর শিকার হতে পারে আমার-আপনার কিংবা ধর্ষকেরও মা-বোন। আমাদের মধ্যযুগীয় গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার কারণে এই ঘটনা ঘটার পর সে নারীর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যে কতটা দুর্বিষহ, যাতনার ও কলঙ্কের জাঁতাকলে পড়ে নিঃশেষিত হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়াও বিবেক-বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই উপলব্ধি করতে পারেন। আর তাই নারী নিপীড়কদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সমাজের প্রতিটি সভ্য মানুষ শুরু থেকেই এই বর্বর অপরাধÑ ধর্ষণের সর্বোচ্চ এবং একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই দাবি করে আসছে। এর পেছনে লজ্জা, ক্ষোভ, আত্মগ্লানি ও ভূলুণ্ঠিত সম্মানের আবেগ, অনুভূতিকে কি অস্বীকার করা যাবে, নাকি কখনও মুছে ফেলা যাবে? আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধগুলো কঠোরভাবে দমনের উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে এই আইনের কিছু ধারা সংশোধন করে ২০০৩ সালে প্রণীত হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩। এই আইন দিয়ে যে অপরাধগুলোর বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো যৌতুক, এ্যাসিড নিক্ষেপ, নারী বা শিশু পাচার, নারী ও শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত মৃত্যু, নারীর আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌন নিপীড়ন, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানি। এই আইনে দলবদ্ধ ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদ- প্রদানের বিধান বলবত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সম্প্রতি সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ সংশ্লিষ্ট আইনের তিনটি ধারা অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন। যার একটিতে বলা ছিল, ধর্ষণের পর কোন ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তি যৌথভাবে যদি কোন নারী বা শিশুর মৃত্যুর কারণ ঘটান, তাহলে আদালত তাকে মৃত্যুদ- দেবেন। কিন্তু এই ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার ফলে ধর্ষককে মৃত্যুদ- প্রদানের বিষয়টি আর আইনে থাকল না। শিশু ধর্ষণকারীর মৃত্যুদ- মানুষের কাছে কাক্সিক্ষত হলেও এখন আর সে সুযোগ নেই। তাই রাজধানীর চাঞ্চল্যকর একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় আরবী শিক্ষক মিনহাজ উদ্দিনকে ফাঁসির রায় দেয়া যায়নি। তাকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদ-। জনস্বার্থে যে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জাতির বহু অমীমাংসিত বিষয়ে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, সেই আদালতের কাছ থেকে ধর্ষণের মতো একটি বর্বর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি বাতিলের বিষয়টি মানুষকে যারপরনাই করেছে হতাশ। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার কি কোনই সুযোগ নেই? এ্যাসিড নিক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদ- নির্ধারণ করার পর সমাজ থেকে এই অপরাধের মাত্রা এখন প্রায় শূন্যের কোটায় চলে এসেছে বলা চলে। ধর্ষণ রোধেও ঠিক তেমনি পদক্ষেপ এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ কি অনুরূপ ফল এনে দিতে পারে না? তা না হলে এই জনপদ কি হবে না ধর্ষকের জন্য অভয়ারণ্য? লেখক : সুইডেন প্রবাসী, ফবযড়ংংধরহ@মসধরষ.পড়স
×