ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গানই আমার সংসার ॥ শহীদুল্লাহ ফরায়জী

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৩১ মে ২০১৫

গানই আমার সংসার ॥ শহীদুল্লাহ ফরায়জী

জীবনমুখী বাংলা গান লিখে সব শ্রেণী পেশার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন দেশের বরেণ্য গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী। চার দশকেরও অধিক সময় ধরে নিরন্তর লিখে চলেছেন মর্মস্পর্শী গান। চলচ্চিত্র কিংবা অডিও এ্যালবামের গানে যার জাদুকরী স্পর্শ তাকে সঙ্গীতাঙ্গনে দেশজোড়াখ্যাতি এনে দিয়েছে। বিশেষ করে সব শ্রেণীর মানুষের অন্তরের বিরহ-বেদনাবিধুর গভীরতা ও অনুভূতিকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। সেই অন্তরাত্মা সন্ধানী শিল্পী মাটি ও মানুষের কবি সম্প্রতি একাধিক চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন। গানগুলো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের শ্রোতাপ্রিয়তা পাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। সাম্প্রতিক সময়ের ব্যস্ততা নিয়ে জনপ্রিয় এই গীতিকবির সঙ্গে একান্তে কথা হয়। সম্প্রতি আপনার লেখা চলচ্চিত্রের গান প্রসঙ্গে জানতে চাই শহীদুল্লাহ ফরায়জী : দীর্ঘ বিরতির পর অনেকগুলো চলচ্চিত্রে গান লিখলাম। সঞ্জয় দে নির্মিত ‘অন্ধগলি’ চলচ্চিত্রের সব গানগুলো আমারই লেখা। এগুলো হচ্ছে- ‘প্রেম মানে ভিতর বাহির পুড়ে যাওয়া’শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, ‘আগুন ফাগুন বয়সে মরেছি ভালবেসে’ শিল্পী এ্যান্ড্রু কিশোর ও ফারজানা আলা উদ্দিন আলী, ‘আমি যারে ভালবাসি সেতো ভালবাসেনা’ শিল্পী নাজনীন মিমি, ‘ভালবাসা শুরু হয় শেষ হয় না’ শিল্পী নাজনীন মিমি ও ‘জীবন হায়রে জীবন’ শিল্পী ফারজানা আলা উদ্দিন আলাী। এছাড়া শাহীন সুমনের ‘মিয়া বিবি রাজি’ চলচ্চিত্রে আমার লেখা ‘আমার কাছে তুমি এখন স্বর্গের চেয়েও বেশি আপন’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কোনাল ও পলাশ। রাজু আহমেদের ‘অসম প্রেম’ চলচ্চিত্রের দুটি গান আমার লেখা। এগুলো হচ্ছে ‘তুমি আমাকে শুধু আমাকে ভালবাসো’ শিল্পী নাজনীন মিমি ও ‘মাটি আর বৃষ্টিতে মাখামাখি হয় যখন’ শিল্পী বেলাল খান ও নির্ঝর। মৌসুমী পরিচালিত ‘শূন্য হৃদয়’ চলচ্চিত্রে আমার লেখা ‘এমন পর করো তুমি স্বপ্নেও যেন দেখা নাহি নয়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। এসব চলচ্চিত্রের কাজ প্রায় শেষের পথে এবং চলতি বছরই মুক্তি পাবে চলচ্চিত্রগুলো। শিল্পের অন্য শাখায় না গিয়ে গীতিকার হলেন কেন? শহীদুল্লাহ ফরায়জী : সঙ্গীত মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে হৃদয়ে দোলা দিতে পারে, বিবেককে আঘাত করতে পারে। মানুষ অতি সহজেই অন্তরাত্মা দিয়ে গানকে উপলব্ধি করতে পারে। আমি এজন্যই গান লেখাকেই বেশি প্রাধান্য দেই। এ যেন আমার জন্মের নৈতিক দায় শোধের মতো। এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্ম নিলাম, সূর্যের উষ্ণতা, বাতাস আর জল থেকে পরিপুষ্ট হচ্ছি, আর আমাকে যে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধের দায় থেকে গান লিখি। গীতিকার হওয়ার প্রথম দিকের কথা বলুন শহীদুল্লাহ ফরায়জী : আমি যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকেই আমার জ্ঞাতে হউক বা অজ্ঞাতে হউক গান লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। প্রচুর গান লিখতাম কিন্তু মাধ্যমের অভাবে সেভাবে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানোর সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৯০ সালের ৪ আগস্ট আমার লেখা প্রথম গান প্রচার হয়। ‘তুমি বিশ্বাসের পাহাড়ে ঝর্ণা কেটে গেছ চলে’ শিরোনামের এ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী রফিকুল আলম। একই দিনে আমার লেখা আরও একটি গান প্রচার হয়। ‘নিন্দুকেরা যতই আমায় মন্দ বলুক’ শিরোনামের এ গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী শাম্মী আখতার। এ দুটি গানের সুর দিয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহ্নেওয়াজ। আমার সঙ্গীত জীবনের পথচলা শুরু হয় সুরকার শাহ্নেওয়াজের হাত ধরেই। চলচ্চিত্রে গান লেখার প্রথম দিকের কথা বলুন শহীদুল্লাহ ফরায়জী : খুব বেশি চলচ্চিত্রে গান লেখার সুযোগ আমার হয়নি। আমি সব সময় আমাদের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যে সব চলচ্চিত্র আমাদের মাটির কথা বলে না, আমাদের জীবনের কথা বলে না সেব সব চলচ্চিত্রের গান করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। চলচ্চিত্রে আমার গান লেখা শুরু হয় ২০০০ সালে মতিন রহমানের ‘মাটির ফুল’ এর মাধ্যমে। চলচ্চিত্রটি সে সময় খুবই ব্যবসা সফল হয়। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন আমার লেখা ‘সোনা দানা দামি গহনা’ গান সে সময় ছিল খুবই শ্রোতাপ্রিয় হয়। যা আজ অবধি বলবৎ আছে। তৌকীর আহমেদের ‘রূপ কথার গল্প’ চলচ্চিত্রে আমার লেখা গানের প্রথম লাইন ছিল ‘লুটেরা কি লুটে নিয়ে গেল’। গান লেখার উপজীব্য হিসেবে মানুষকে বেছে নিলেন কেন? শহীদুল্লাহ ফরায়জী : পৃথিবীতে মানুষ শ্রেষ্ঠ। আমি সব সময় মানুষের ভেতরের সবচেয়ে ভাল দিকটা দেখতে চেয়েছি। মানুষের মর্যাদা আমার কাছে সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। এ কারণেই আমি মানুষকে নিয়ে গান লিখি। আপনার গানের আলাদা বৈশিষ্ট্য কি? শহীদুল্লাহ ফরায়জী : আমি গানের মধ্যে মানুষের হৃদয়ের চাঁপা পড়া কথা বা অনুভূতি অথবা উপলব্ধিকে উন্মোচিত করতে চেয়েছি। মানুষের অন্তরের গভীরতর জায়গাকে স্পর্শ করতে চেয়েছি। বিরহ-বেদনার কথা রচনা করে মানুষকে আন্দোলিত করতে চেয়েছি। আপনার লেখা গান দেশি ও বিদেশী শিল্পীরা গেয়েছেন.. শহীদুল্লাহ ফরায়জী : আমার গানের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ শতাধিক। অনেকেই আমার গান গেয়েছেন। শিল্পী রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, এ্যান্ড্রু কিশোর, মনির খান, বেবি নাজনীন, ডলি শায়ন্তনী, আলম আরা মিনু, বারী সিদ্দিকী, আসিফসহ প্রায় সবাই। এছাড়া ভারতের শিল্পী অলকা ইয়াগনিক, কুমার শানু, মিতালী মুখার্জীও আমার লেখা বহু গান গেয়েছেন। সঙ্গীতাঙ্গনে আপনার দীর্ঘ জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে বলুন.. শহীদুল্লাহ ফরায়জী : বাংলা ভাষা-ভাষী কোটি কোটি মানুষের গভীর ও নির্মল ভালবাসা পেয়েছি। অপ্রাপ্তির কথা যদি ধরি তাহলে বলতে হয়, একজন মানুষের জীবনে যে নৈতিক সৈন্দর্যে নিজেকে আবৃত রাখা দরকার, যে সত্যের ভিত্তির ওপর নিজেকে বিনির্মাণ করা দরকার, আর যে নৈতিক শক্তিতে নিজেকে উদ্ভাসিত করা দরকার সেটা আমার হয়নি। এ কারণেই আমি অতৃপ্ত, অশান্ত ও অস্থির। -গৌতম পাণ্ডে
×