ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি নাও হতে পারে!

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ মে ২০১৫

মোদির সফরে তিস্তা চুক্তি নাও হতে পারে!

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তিকেই আলোচনায় প্রাধান্য দেবে ঢাকা। সীমান্ত চুক্তির পরে এখন তিস্তা সমস্যা সমাধানে ঢাকার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়েই দিল্লী তিস্তা সমস্যার সমাধানে আগ্রহী। এজন্য মোদির সফরে মমতাকে ঢাকায় এনে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে চায় দিল্লী। ঢাকা-দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মোদির এবারের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের তিস্তা সমস্যাই প্রধান আলোচনায় থাকছে। এবার ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি না হলেও সমস্যা সমাধান যেন দ্রুত হয় সে বিষয়ে আলোচনার প্রস্তুতি নিয়েছে ঢাকা-দিল্লী। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোদির এবারের সফরে তিস্তা চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হবে। এই সফরে তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত সুরাহা না হলেও দ্রুত যেন এ সমস্যার সুরাহা হয়, সেটাই আশা করছে ঢাকা। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তির যে কাঠামো চার বছর আগে তৈরি হয়েছিল, তা ঠিক রেখে তিস্তা নদীর কতটুকু পানি বাংলাদেশ পাবে, তা নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেছেন, তিস্তা চুক্তির ইনিশিয়াল হয়েছিল ২০১১ সালে। মোদি সাহেব যখন আসবেন তখন তিনি আমাদের জন্য খবর নিয়েই আসবেন। আমি এতটুকু বলতে পারি, আলোচনাটা আমরা রি-ওপেন করছি না, রি-নেগোশিয়েটও করছি না। যেখানে নেগোশিয়েশন হয়েছে সেখানেই থাকবে। আমাদের যা ন্যায্য দাবি, যত পানি প্রয়োজন সেটুকু আমরা পাবই। এদিকে তিস্তা চুক্তির সমাধানে আগ্রহী দিল্লীও। তবে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে দিল্লী কোনভাবেই এই চুক্তি করতে পারছে না। সে কারণেই মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়েই তিস্তা সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তিস্তা চুক্তি সমাধানের লক্ষ্যে ধীর গতিতে সামনে এগোতে চাইছে মোদি সরকার। দীর্ঘদিনের তিস্তা সমস্যা সমাধানে আরও কিছুদিন সময় নিতে চায় দিল্লী। সে কারণে মোদির ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত সমাধান না হলেও বিশেষ অগ্রগতি হবে বলে আশা করছে ভারত। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরসঙ্গী হিসেবে মমতাকে প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি প্রথমে রাজি হননি। এর পর তিস্তা চুক্তির বিষয়টি আলোচনায় বাদ দিলে মমতা মোদির সঙ্গী হিসেবে ঢাকায় আসতে পারেন বলে শর্ত জুড়ে দেন। সেই শর্তেই মমতা ঢাকায় আসছেন। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র মতে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে মোদি সরকার এখন ধীরে এগোতে চায়। সে জন্য মোদি এখনই তিস্তা চুক্তি না করতে পারলেও পরবর্তীতে দ্রুত সময়ে এই চুক্তি সম্পন্ন করতে চাইছেন। তবে তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে মমতাকে রাজি করাতে উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লী। আর মমতার ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে সেটা আরও সহজ হবে। সে কারণে যেভাবেই হোক মমতাকে সফরসঙ্গী হিসেবে চাইছেন মোদি। তিস্তা চুক্তি এখনই না করতে পারলেও বিষয়টির সুরাহা করতে চাইছে মোদি সরকার। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মোদির সফরকালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। কেননা, বিষয়টিই এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত ইস্যু। বাংলাদেশ আশা করছে, মোদি সরকার অবিলম্বে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন করবে। এদিকে কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। এই নিবার্চনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছেন মমতা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিভিন্ন খাতে বেশি বরাদ্দ পেতে মমতা ‘তিস্তা চুক্তি’কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। কারণ, তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মমতার আর কদর থাকবে না। সে কারণে তিনি কেন্দ্র থেকে বেশি সুবিধা আদায়ও করতে পারবেন না। মূলত এই দুই কারণেই মমতা তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করছেন। তাই আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত তিস্তা চুক্তির বিষয়টি সুরাহা নাও হতে পারে। ইতোমধ্যেই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের আগেই ছিটমহলবাসীকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মমতা তিন হাজার ৯ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে তিস্তা অববাহিকার জেলাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত পানি রেখে তারপর বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আগ্রহী মমতা। এ জন্য ভারতের নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে তিনি একটি কমিটিও গঠন করেছেন। কমিটির সদস্যরা কয়েকদিন আগে তিস্তা নদীর উৎসস্থল সিকিমও ঘুরে এসেছেন। মমতা চাইছেন, বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেয়ায় পশ্চিমবঙ্গে পানির প্রবাহ কমলে, তা সিকিমের অন্যান্য নদী থেকে পূরণ করা হবে। অবশ্য কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন এখনও পাননি মমতা। ওই প্রতিবেদন পেলে তিনি তিস্তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে বলছে কলকাতার কূটনৈতিক সূত্র। এদিকে দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র আভাস দিয়েছে, মোদির ঢাকা সফর সামনে রেখে তিস্তা নিয়ে মমতাকে রাজি করাতে এখনও দিল্লী-কলকাতা আলোচনা চলছে। শেষ সময়ে তিস্তা নিয়ে মোদি-মমতা চমক দেখাতেও পারেন। তবে সেই চমক দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোন উপায় নেই। ২০১১ সালে সে সময়কার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে দুই দেশে আশার সঞ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা ঝুলে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে এসে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি পাবে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনাকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা জানান, কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে তিস্তা চুক্তি করা হবে। উল্লেখ্য, আগামী ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসছেন। মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ সীমান্তের পাঁচ প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, অসম, মিজোরাম ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীও মোদির সঙ্গী হবেন। মোদির ঢাকা সফর সামনে রেখে ঢাকা-দিল্লী এখন ব্যস্ত সময় পার করছে।
×