ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহী বোর্ডে ৭ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও চার হাজতির সাফল্যগাথা

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বগুড়ার রাফি পাস করেছে জিপিএ-৫ পেয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩১ মে ২০১৫

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বগুড়ার রাফি পাস করেছে জিপিএ-৫ পেয়ে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রতিবন্ধকতা তাদের পদে পদে বাধা। কিন্তু শিক্ষা গ্রহণের অদম্য ইচ্ছার সামনে মাথা নত করে সব প্রতিবন্ধকতা। সব কিছু পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চলে সামনের পথে। প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেই তারা ছিনিয়ে আনে বিজয়। কেউ কেউ শারীরিকভাবে সবল নয়, অনেকে আবার বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু ইচ্ছার চাকা কি কোন বাধা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় থেমে থাকে? নিজেদের ইচ্ছায় সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় মেধাবীরা। এমনি সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে নিজেদের সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছে রাজশাহী বোর্ডের সাত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও চার হাজতি শিক্ষার্থী। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অন্যের সহযোগিতা নিয়ে পড়ালেখায় অর্জন করেছে সাফল্য। অন্যদিকে কারাগারে বসে দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করে নিজেদের সফলতা ফিরিয়ে এনেছেন চার শিক্ষার্থী। জীবনের বাঁকে তাদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে কোন কিছুতেই ভয় পায়নি ওরা। প্রবল মনোবল নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। এই মনোবলেই তারা অর্জন করেছে সাফল্যের চাবি। সিয়াম, মনসুর, জামিল, ওয়াহেদ, রবিউল, মাহবুব ও জান্নাতুল মাওয়া সবাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে কেউ তাদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় রাজশাহী বোর্ডে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে ওরা সাতজন। এদের কেউ স্বপ্ন দেখছেন ডাক্তার বা ব্যারিস্টার হতে। কেউবা বিসিএস পাস করে সরকারী চাকরি করতে চান। এদের মধ্যে একমাত্র এবিআই রাফি সিয়াম জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে এবারের পরীক্ষায় অংশ নেয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এ পরীক্ষার্থীর শ্রুতিলেখক ছিল বগুড়ার দারুল ইসলাম নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আলিম উল ফাহাদ সিহাব। নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের সহায়তায় নিয়মিত ক্লাস করত সে। আর বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের মুখে উচ্চারিত পড়া শুনে মুখস্থ করত। শুনে শুনে পড়ালেখা আয়ত্ত করত সিয়াম। সব সময় পরিবারের সদস্যদের পাশে পেত না বলে মুঠোফোনে পড়া রেকর্ড করে পড়ত। পড়ালেখার প্রতি প্রচুর আগ্রহ থাকায় একটু সময়ও নষ্ট করত না। যখই সুযোগ পেত তখনই মুখস্থ পড়া আবার পড়ত যাতে ভুলে না যায়। এভাবেই দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করেছে। এভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াতেই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে সিয়াম। অন্য ছয় প্রতিবন্ধীর মধ্যে মনসুর আলী পাবনার ভাড়ারা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবারের পরীক্ষায় অংশ নেয়। সে জিপিএ-৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। পাবনার ভাড়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের আরও তিন শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম, জামিল হোসেন ও মাহবুব আলম। এদের মধ্যে রবিউল ও জামিল পেয়েছে জিপিএ-৪.৬৭। আর মাহবুব উত্তীর্ণ হয়েছে জিপিএ-৪.০০ পেয়ে। রবিউল ইসলাম, জামিল হোসেন ও মাহবুব আলমের শ্রুতিলেখক ছিল যাথাক্রমে চর বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সাগর হোসেন, মাহমুদপুর জায়েদ আলী সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সুমন হোসেন ও চর বলরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এনামুল কবির। এছাড়া সিরাজগঞ্জের এসবি রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থী আব্দুল ওয়াহেদ জিপিএ-৪.৬১, এবং বগুড়া সেন্ট্রাল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া জিপিএ-৩.৩৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এরা সকলের শ্রুতিলেখক নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এসব পরীক্ষার্থীর কৃতিত্বে তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাজশাহী বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক সামসুল কালাম আজাদ। একই সঙ্গে তাদের উন্নত ভবিষ্যত কামনা করেছেন তিনি। এদিকে এবার রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে (হাজতি) ৬ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। এদের মধ্যে চারজনই পেয়েছে জিপিএ-৫। এরা হলো রাজশাহী গব. ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের শিক্ষার্থী জাহিদ হোসেন রাশেল, আরিফ রায়হান, নাজমুল হাসান স্বপন ও রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ের মিজানুর রহমান। এছাড়া মাছকাটাদীঘি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন পেয়েছে জিপিএ-২.৬৭ পয়েন্ট এবং শিবপুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মামুন আলী এফ-১ গ্রেড পেয়েছে। স্কুল সূত্রে জানা যায়, নাশকতার মামলায় এই ছয় শিক্ষার্থী রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে থেকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। বগুড়া অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান ॥ তীব্র আত্মবিশ্বাস, একাগ্রতা ও অধ্যবসায় নিয়ে এবারের মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বাবা আফেলুর রহমান ও মা নাজমা রহমানের একমাত্র সন্তান সে। বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাড়ি শহরতলির মালতিনগরে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রমজান আলী জানান, সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে মেধাবী আবি রাফি মোঃ সিয়াম তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর প্রতিটি শ্রেণীতে সে ভাল রেজাল্ট করে। মাধ্যমিকে সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা আব্দুল জলিলের সহযোগিতায় শ্রুতি লেখক নির্বাচন করলে ব্রেইল পদ্ধতিতে সে পরীক্ষা দেয়। বাবা আফেলুর রহমান বললেন একমাত্র সন্তানের চোখের চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কোন ফল হয়নি।
×