ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দামানে মার্কিন অনুসন্ধান চলছে

রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের মনোভাব মানবতাবিরোধী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩১ মে ২০১৫

রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের মনোভাব মানবতাবিরোধী

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে সর্বশেষ যে মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে তা রীতিমতো মানবতাবিরোধী হিসেবে বিবেকবান সকল মহলকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক শক্তিশালী সম্প্রদায়গুলো এখনও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের অমানুষিক নির্যাতন ও দেশান্তরী হতে বাধ্য করার ঘটনাবলীতে কার্যকর কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় না হওয়ায় হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্দামান সাগরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও কিছু বাংলাদেশী নাগরিকের মালয়েশিয়ায় অভিবাসী প্রত্যাশী হওয়ার পথে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শুক্রবার থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে যে সতেরো দেশীয় আঞ্চলিক সম্মেলন হয়েছে তাতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যে একগুঁয়েমি ও রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে তা নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে তুমুল বাকবিত-ার ঘটনাও ঘটেছে। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দানের ব্যাপারে শক্তিশালী দেশ চীন বিষয়টি সে দেশের অভ্যন্তরীণ বলে যে বক্তব্য দিয়েছে তা প্রকারান্তরে আন্দামান সাগরে ভাসমান মানবতা ও মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আবিষ্কৃত গণকবর ও বন্দী শিবিরের নৃশংসতাকে আড়ালে রাখার চেষ্টাই হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলে আলোচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের অমানবিক আচরণ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ফলে রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে, উচ্ছেদ হচ্ছে এবং দেশান্তরী হওয়ার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরই জের হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্দামান সাগরে অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের ঢল নামে। অভিবাসীদের নিয়ে থাই ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে বন্দীশিবির ও গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেলে এদের প্রতি মানবিক সহায়তা দানের আহ্বান আসে বিশ্বের বহু দেশ ও সংস্থা থেকে। এর ফলে ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়া সরকার অভিবাসীদের বড় একটি দলকে সে দেশে আশ্রয় দিয়েছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে উদ্ধার হয়েছে আরও বহু। কিন্তু এসব দেশ রোহিঙ্গা বা অভিবাসীদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় ও আর্থিক সহায়দা দিতে নারাজ। এর ফলে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গা ও দেশান্তরীদের ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ ও শঙ্কা বিরাজ করছে। সর্বশেষ ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এখনও কয়েক হাজার অভিবাসী সাগরে ভাসমান অবস্থায় থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সর্বশেষ থাইল্যান্ডের নৌবাহিনী ভাসমান ৭২৭ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে। এর আগে সে দেশের জলসীমা থেকে উদ্ধার হয় ২০৮ জন। এ ২০৮ জনের দলটিকে এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের উখিয়া ঘুনধুম বালুখালি পয়েন্টের নিকটবর্তী এলাকায় সেনা নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পে জড়ো করে রাখা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যেভাবেই হোক এসব উদ্ধারকৃতদের তারা বাংলাদেশী বলে চালিয়ে দিয়ে পুশব্যাকের প্রচেষ্টায় থাকবে। কিন্তু বিজিবি সদস্যদের কঠোর নজরদারি ও টহলের কারণে হয়ত তা এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। সতের বিজিবি সেক্টর কমান্ডার সূত্রেও আশা করা হচ্ছে মিয়ানমার এ ধরনের বেআইনী কর্মে লিপ্ত হবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে মিয়ানমারের নাগরিক হয়ে রোহিঙ্গারা সেদেশে সকল প্রকার ন্যায্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং তাদের ওপর বার বার সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী হামলে পড়ছে এবং তাদেরকে ইন্ধন দিচ্ছে সে দেশের সামরিক জান্তাÑ সেক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে এসব মিয়ানমারদের পুশব্যাক করার ক্ষেত্রে আইনগত আচরণ আশা করার অবকাশ থাকে না। এদিকে, আন্দামান সাগরে অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাশীদের যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তাতে প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য। এ সংখ্যা নিরূপণে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন সংস্থা। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখনও দাবি করা হচ্ছে, আন্দামান সাগর জুড়ে অভিবাসী বোঝাই অসংখ্য ছোট বড় নৌযান এখনও ভাসমান রয়েছে। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে আন্দামানে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাদের সঙ্গে এখন যোগ দিয়েছে মার্কিন সেনাবাহিনী। থাই সরকার মার্কিন সেনাবাহিনীর এ তল্লাশি অভিযানের অনুমতি দিয়েছে। এদিকে, আন্দামান সাগরে প্রাণ হারানো অনেকের লাশ ভেসে আসতে শুরু করেছে। হতভাগ্য অভিবাসী প্রত্যাশীদের লাশ শুধু বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারতীয় উপকূলে গিয়েও ঠেকতে পারে। শনিবার প্রাণ হারানো দুই অভিবাসীর লাশ পৌঁছেছে উখিয়ার ইনানী সমুদ্র উপকূলে। এর মধ্যে গলিত একটি লাশ পুলিশ উদ্ধার করেছে। আরেকটি জোয়ারের টানে পুনরায় সাগরে ভেসে গেছে। উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী সৈকত এলাকায় মনখালীর ছোয়ানখালী চরে শনিবার সকালে দুই অভিবাসীর লাশ প্রত্যক্ষ করে এলাকাবাসী। পচা দুর্গন্ধে সমুদ্রের চরে পড়ে থাকা ওই লাশের কাছেও যাওয়া যাচ্ছিল না বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ধারণা করা হচ্ছে, মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে দালাল চক্রের নির্যাতনে এরা প্রাণ হারানোর পর সাগরে ফেলে দেয়া হয়েছে। লাশ দুইটি বিকৃত হয়ে পড়ায় তাদের চেহারাও চেনা যায়নি। পুলিশ বলছে- তারা একটি গলিত লাশ উদ্ধার করেছে। আরেকটি তারা খুঁজে পায়নি। উদ্ধারকৃত লাশটির ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত লাশটির শরীরের মাঝখানে সামান্য মাংসপি- ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরো শরীরটিই আস্ত একটি কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। ২৮ গডফাদারকে খুঁজছে পুলিশ ॥ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ মানব পাচারকারীদের ধরতে মাঠে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতোপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তালিকা ছাড়া আরও শতাধিক মানব পাচারকারী দালাল চক্রের নামের তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাদের অচিরেই আইনের আওতায় আনা হবে। কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় গত ৩ বছরে দায়েরকৃত মানব পাচার মামলাগুলোতে তালিকাভুক্ত আসামিদের আটকের জন্য অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ পুলিশ কর্মকর্তার তথ্যমতে মানব পাচারকারী ২৮ জন গডফাদারকে খুঁজছে তারা। জানা গেছে, পুলিশ, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রতিরাতে সম্ভাব্য বিভিন্ন সন্দেহজনক স্থানে পুলিশী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু মূল গডফাদারদের কেউ ধরা পড়ছে না।
×