ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তামাকজনিত রোগে দেশে বছরে মারা যাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৩১ মে ২০১৫

তামাকজনিত রোগে দেশে বছরে মারা যাচ্ছে লক্ষাধিক মানুষ

শাহীন রহমান ॥ তামাক সেবনের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬০ লাখের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এক গবেষণায় দেখা গেছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশেও প্রতিবছর লাখের ওপর মৃত্যুবরণ করছে। যারা নিয়মিত তামাক সেবন করছে তাদের প্রতি দুইজনের একজন তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যুবরণ করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক সেবন মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। তামাকের কারণে বিভিন্ন রকম ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, এজমাসহ নানা মৃত্যুঘাতী রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যে পরিবার এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে পরিবার নানা সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে। এসব রোগে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেও সরকারের স্বাস্থ্য খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন ধরে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি লোক তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। প্রতিবছর বিশ্বের ৬০ লাখের বেশি লোক তামাক সেবনের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশে তামাক সেবনের হার অনেক বেশি। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী দেশে ৪৩.৩ ভাগ লোক বিভিন্নরকম তামাক ব্যবহার করে থাকে। সংখ্যায় তামাক ব্যবহারের হার প্রায় সোয়া চার কোটি। তামাক সেবনজনিত মৃত্যুর সংখ্যাও দেশে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিবছর তামাক সেবনের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখের অধিক লোক মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১০ সালের পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের প্রায় ৯৮.৭ ভাগ মানুষের মধ্যে অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। ৭৭.৪ ভাগ মানুষের মধ্যে অন্তত দুটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। ২৮.৩ ভাগের মধ্যে অন্তত তিনটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে যথাক্রমে ১৭.৯ ভাগ এবং ৩.৯ ভাগ। যা তামাক সেবনের কারণে মূলত হয়ে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে যত সিগারেট বিক্রি হয় তার ১০ ভাগের একভাগ চোরাচালানের মাধ্যমে বিক্রি করা হলেও এর প্রভাব অনেক বেশি। সিগারেট ও তামাকের চোরাচালান শুধু উন্নত দেশের সমস্যা নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা। Ÿাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ঢাকাসহ দেশে চোরাচালানের সিগারেটে বাজার সয়লাভ। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অধিকাংশ সিগারেট বিক্রয় কেন্দ্রেই চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সিগারেট পাওয়া যায়। দেশের বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে, সতর্কবাণী ব্যতীত কোন সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। অথচ বিদেশী এসব সিগারেট বাজার থেকে উচ্ছেদে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ সংস্থার মতে দেশে সিগারেটসহ তামাকজাত দ্রব্যের চোরাচালানের সঙ্গে তামাক কোম্পানিগুলো জড়িত। তাদের সমর্থন ছাড়া উৎপাদিত পণ্য বাজারে বা চোরাকারবারিদের হাতে পাওয়া সম্ভব নয়। তামাক কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দেয়াসহ অধিক মুনাফার জন্য এ অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাদের মতে সিগারেট চোরাচালান শুধু স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়। এটি অর্থনৈতিক উন্নতির পথেও অন্তরায়। চোরাকারবারিরা সিগারেট চোরাচালানের অর্থ দিয়ে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান করে থাকে। ঢাকা আহছানিয়া মিশন পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে বিভিন্ন সিগারেটের ব্রান্ডসহ ১১৫টি তামাকজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। যা অবৈধ পথে দেশে আসছে। ভোক্তাদের মধ্যে যারা অবৈধ বিদেশী সিগারেট পান করেন তাদের ৪৮ ভাগ ভিন্ন স্বাদ, ২২ ভাগ সহজলভ্যতা এবং ২২ ভাগ সামাজিক অবস্থানের কারণে এসব বিদেশী সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান করে থাকেন। এ গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয় দেশে উৎপাদিত সিগারেটের শতকরা ৮ ভাগ ব্যান্ড রোল ব্যতীত। অর্থাৎ কর ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি যেমন রয়েছে তেমনি হতাশাও রয়েছে। সাধারণ মানুষকে তামাকের নেশা থেকে দূরে রাখতে যে রকম কঠোর অবস্থান দরকার সে ধরনের কোন পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে মৃত্যুঘাতী তামাক ব্যবসা প্রসারের মাধ্যমে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। তামাক কোম্পানির প্রভাবের কারণে সরকারকে প্রায়শই নতিস্বীকার করতে দেখা যায়। তবে আশার কথা সরকার ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে ২০০৫ সালে নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করেছেন। ২০০৬ সালে এর বিধিমালা জারি করা হয়। ২০০৭ সাল থেকে সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে জেলা উপজেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন করে। সারাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয়েছে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল। ২০১৩ সালে সরকার এ আইনের সংশোধনী পাস করে। এ বছর ১৫ মার্চ পাস করা হয় আইনের বিধিমালা। বিধিমালা অনুযায়ী আগামী বছরের মার্চ থেকে বিড়ি, সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ছবিসহ সতর্কবাণী প্রদান করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে তামাকজাত দ্রব্যের ওপর করহার তুলনামূলক কম হলেও ক্ষতিকর এসব পণ্যের ওপর আলাদাভাবে স্বাস্থ্যকর আরোপ করার পদক্ষেপ বৈশ্বিক পরিম-লে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের তামাক নিয়ন্ত্রণসহ জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে ইতিবাচক উদ্যোগকে অনুকরণীয় হিসেবে দেখছে তারা। স্বাস্থ্যকর হিসাবে গৃহীত অর্থের সঠিক ব্যবহারের পদক্ষেপ বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে আর সুসংহত করবে বলে তারা উল্লেখ করেন।
×