ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল আলম

মানব পাচার এবং বিদেশে কর্মসংস্থান

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ৩১ মে ২০১৫

মানব পাচার এবং বিদেশে কর্মসংস্থান

সুদীর্ঘ কয়েক বছর ‘টকশো’ প্রযোজনা ও উপস্থাপনা করেছি। এখন নানা কারণে আর করি না। তবে বিষয় আকর্ষণীয় বা গুরুত্বপূর্ণ হলে অন্যদের টকশো দেখি। চলতি সময়ে হাজার হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সমুদ্রে ভাসছে, মালয়েশিয়ায় শত শত গণকবর মিলছে, ভূমধ্যসাগরে আফ্রিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের তীর থেকে শত সহস্র নর-নারী, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ ইতালি ও গ্রীসে অভিবাসন করার জন্য ভাঙ্গাচোরা নাবিকহীন নৌকায় ভাসছে, আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে প্লেন থেকে ছুড়ে ফেলা ত্রাণবস্তু সংগ্রহে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছেÑ এসব নিয়ে যেসব টকশো হচ্ছে, সেসব দেখার চেষ্টা করি। বিষয়টি এতই গুরুত্ব পেয়েছে যে, আন্তর্জাতিক সকল খবর ও তথ্য সংস্থা সেসব বিশ্বময় প্রচার করছে। তারপরেও এই অভিবাসনে ইচ্ছুক জনগোষ্ঠীর সম্যক অবস্থা, অতীতের অবস্থান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সম্পর্কে এই বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় এবং সেটার অধীনে থাকা ‘ব্যুরো’ কোন ‘টকশো’তে বক্তব্য রেখেছে বলে আমার গোচরে আসেনি। এই দেশে একটা সরকারী প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকা- বা দায়িত্ব পালন করার কথা, সেসব কাজ করার জন্য বিদেশী অর্থপুষ্ট বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। লবণে আয়োডিন দেয়ার কাজটা করার জন্য ব্র্যাক অনেক সাহায্য নিয়ে এসে সরকারী দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিল। পাবলিক লাইব্রেরি থাকতেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র জ্ঞান বিতরণ করে সমাজে অবক্ষয় ঠেকাতে অনেক অর্থ নিয়ে এলো। দারিদ্র্য দূর করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও অনেক ছোট প্রকল্প বৈদেশিক সাহায্য পেল। এরকম উদাহরণ হাজারটা আছে। অথচ অভিবাসনে বা বিদেশে কর্মসংস্থানে গবেষণা করার জন্য ইন্টারন্যাশানাল অফিস অব লেবার (আইএলও) এবং ইন্টারন্যাশানাল মাইগ্রেশন অফিস (আইএমও) অনুদান দিলেও বাস্তব অভিবাসনে তারা ট্রেইনার দেয়া ছাড়া আর কিছু করে না। পাঠক হয়ত জানতে চাইবেন, সরকারের কোন্ প্রতিষ্ঠানের ওপর বহির্গমন ও বিদেশে কর্মসংস্থানের দায়িত্ব আছে? শুনলে অনেকে আশ্চর্য হবেন, এটা মোটেই একটা ছোট মন্ত্রণালয় নয়। এর নাম ‘মিনিস্ট্রি অব এক্সপাট্রিয়েট ওয়েলফেয়ার এ্যান্ড ওভারসীজ এমপ্লয়মেন্ট’। এর অধীনে একটা শক্তিশালী ‘ব্যুরো’ কাজ করে, সেটার নাম ‘ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড ট্রেইনিং’, সংক্ষেপে অধিক পরিচিত নাম ‘বিএমইটি’। স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মধ্যে (১৯৭৬ সালে) এদের কার্যক্রম শুরু হয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রম দফতর বা আইএলওর বিভিন্ন কনভেনশনে এই ব্যুরো শামিল হয়েছে (১৯৮৭ থেকে ১৯৯৭)। এই ব্যুরোর তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী ৪২টি ডিস্ট্রিক্টে ম্যানপাওয়ার ও এমপ্লয়মেন্ট অফিস (সংক্ষেপে ‘ডেমো’) আছে, ২৮টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার আছে, চারটি নৌযান প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি) চলে। এদের কর্মকা- কাগজে-কলমে বিশাল এবং যে কেউ ওয়েবসাইটে ইগঊঞ লিখলেই এদের বিস্তারিত বিবরণ চলে আসবে। এই বিএমইটি-র কাজ কী? মনে হয় যারা বিদেশে কর্মসংস্থানে যেতে চায় তাদের সাহায্য করা এবং সে জন্য বিস্তারিত শর্ত ইত্যাদি তৈরি করা আছে। সেসব পূরণ করলেই বিএমইটি-র মাধ্যমে কর্মীরা নির্ভয়ে ও কম খরচে বিদেশে যেতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হলো যে, এই দেশ থেকে যারা বিদেশে শ্রম বিক্রি করতে যেতে চায় তাদের অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত (অশিক্ষিতও অনেক) এবং তাদের পক্ষে বিএমইটি-র শর্ত পূরণ করা আর হিমালয় পর্বত অতিক্রম করা একই। এ অবস্থায় বিএমইটি-র সূত্র থেকে তথ্য সুচতুরভাবে নানা পন্থায় বের করে আনে তথাকথিত আদম বেপারীরা। বিএমইটি অফিস খুলে বসে আছে যে যোগ্য ক্যান্ডিডেটরা তাদের কাছে আসবে এবং বিএমইটির ‘অফিসাররা’ বিদ্যুতচালিত পাখার নিচে চেয়ারে বসে কাজ করবে। তারা ক্যান্ডিডেটদের কাছে যাবে না, গেলে তাদের সম্মান থাকে না। অপরদিকে এই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ নেয় আদম বেপারীরা। তারা গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে ‘ক্যান্ডিডেট’ খুঁজে বের করে, তাদের লোভ দেখিয়ে, বিশেষ করে দাফতরিক কাজ সব করে দেবে এসব আশ্বাস দিয়ে মানুষ সংগ্রহ করে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ত্বরিত কর্মে সাধারণত বিদেশে মজুর হতে আগ্রহীরা ধরা দেয়। অনেকে ঠিকই বিদেশে যেতে পারে, কিন্তু অধিকাংশই পারে না। শুরুতে লিখেছি, সরকারী কাজ করে দেয় বেসরকারী বিদেশী সাহায্যপুষ্ট সংস্থা (এনজিও)। তাতে সরকার দন্তবিকশিত করে বিগলিত হয়ে যায়। অথচ এনজিওগুলোকে অর্থ দেয়ার নামে বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো সরকারকে যে নানা শর্তে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে, সে সম্পর্কে সরকার নির্বিকার। তাহলে এই বিএমইটি-র কাজের জন্য একটা বা অনেক এনজিও তৈরি হচ্ছে না কেন? হচ্ছে, একটা নয় অনেক এবং সবই দিনে-দুপুরে অবৈধভাবে বহির্গমনে ইচ্ছুক অথচ বিএমইটি-তে যাওয়ার ক্ষমতা নেই, তেমন সব ‘ক্যান্ডিডেটকে’ নিয়ে কাজ করছে। এসব তথ্য গোপন নয়, অন্তত বিএমইটি-র কর্মকর্তাদের কাছে তো নয়ই। তবে এই অবৈধ কর্মকা- বন্ধ করা হচ্ছে না কেন? কারণ, এরা বন্ধ হলে এই বিদেশে কর্মরত শ্রমিক সংখ্যা কমে যেতে বাধ্য। আর এই কমে যাওয়ার অর্থ দেশের ‘রেমিটেন্স’ কমে যাবে। এসব ছাড়াও একটা বড় স্বার্থগোষ্ঠীর অবৈধ রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। এই স্বার্থগোষ্ঠী পরিচালিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান অফিস রাজধানীতে ও মফস্বলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে। এদের মালিক ও কর্মীদের এবং এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ‘ফ্রিল্যান্স’ দালালদের সবাই চেনে। সাধারণ মানুষের চেনা আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চেনার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। সেই সুযোগে সমস্যা হলেই এই অফিস তালাবদ্ধ হয়ে যায়, মালিকদের খুঁজে পাওয়া যায় না, কর্মী ও দালালরা সাময়িকভাবে ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়। এদের অবৈধ ব্যবসার শিকার যারা, তাদের কথা ভাবার অবসর কারও খুব একটা নেই। এই রচনা লেখার সময় জানা গেল, বঙ্গোপসাগরে কমপক্ষে ২৬০০ অবৈধ কর্মসংস্থানে আগ্রহী ব্যক্তি ভাসছে, শত শত মানুষের গণকবর পাওয়া গেছে এবং আরও শত সহস্র্র নরনারী ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, রোগে প্রাণ হারাচ্ছে। যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই বিএমইটি তাদের নামে যুক্ত আছে ‘এক্সপ্যাট্রিয়েট ওয়েলফেয়ার’-এর কাজ। অবশ্যই তারা দাবি করবে যে, অবৈধ অভিবাসনকারীদের সাহায্য তাদের কাজ নয়। উত্তম কথা, তাহলে কার কাজ? কারোরই নয়, ওরা অবিমৃশ্যকারীর মতো অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে মরতে গেছে, তারা মরুক। এই হলো আমাদের মানবতার শিক্ষা। একই সময়ে রাজধানী ঢাকায় একটা রাস্তা দেবে গিয়ে একটা বড় হোটেল ভেঙ্গে পড়তে পারে সে ভয় দেখা দিতেই রাজউক, পূর্ত মন্ত্রণালয়, মেয়োরাল অফিস সবাই তৎপর হয়েছে দেখে খুব প্রীত হচ্ছি। যদিও এখানে এখন পর্যন্ত কোন প্রাণহানির ঘটনা হয়েছে বা হবে তেমন মনে হচ্ছে না, সরকারী উদ্বেগ ও কর্মতৎপরতা প্রশংসনীয়। আমি ভাবছি প্রাণহানিই মূল কথা নয়, কোটি কোটি বা সহস্র কোটি টাকার সম্পত্তি ও বিনিয়োগ আছে বলেই না সবাই চিন্তিত! তাই নয় কি? সেই বিশাল অর্থ-সম্পদের তুলনায় কয়েক হাজার মানুষ সমুদ্রে মরতে যাওয়া কিছুই না। তাছাড়া ওই মানুষগুলোর দায়িত্ব তো প্রথম থেকেই সরকারের ছিল না, ওরা অবৈধ। সে জন্যই কি সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রী তাদের হয়ে কথা বলছেন না? একজন সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আপ্তবাক্য ছেড়েছেন যে, বাংলাদেশ সকলকেই আশ্রয় দেবে। কিন্তু সে সরকারের পক্ষ হয়ে বলল কি না, তা বোঝা গেল না। তারপরেও আমার মনে প্রশ্ন জাগে, ওই অবৈধ মানুষগুলো তো আমাদেরই আত্মীয় ও সন্তান-সন্ততি। ওরা অবৈধ হয়েছে, কারণ বিএমইটি তাদের জন্য কিছু করেনি। সুতরাং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব তাদের প্রতিও বর্তায়। লেখক : সংস্কৃতি গবেষক ও কথাশিল্পী
×