ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এমএ জব্বার

তামাকের ব্যবহার প্রতিরোধে সকলের অংশগ্রহণ

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৩১ মে ২০১৫

তামাকের ব্যবহার প্রতিরোধে সকলের অংশগ্রহণ

তামাকের বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি যেমন ক্যান্সার, হার্টের বিভিন্ন রোগ, স্ট্রোক, চুল পড়া, চোখে ছানিপড়া, শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পচন এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা ও সাদা পাতা ব্যবহারের ফলে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ও এসব রোগের বিপরীতে চিকিৎসা ব্যয়ের প্রত্যক্ষ খরচ ছাড়াও অসুস্থতার কারণে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং এর ফলে উৎপাদন ঘাটতির কারণে পরোক্ষ আর্থিক ক্ষতির ভয়াবহতা ও কুফল সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস আবারও সমাগত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতি বছরের ন্যায় বাংলাদেশে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এ দিবসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারিত থাকে। এবারের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ঝঃড়ঢ় রষষরপরঃ ঃৎধফব ড়ভ ঃড়নধপপড় অর্থাৎ তামাকের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ কর। সদস্য দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তামাক প্রতি বছর বিশ্বে ৬০ লাখ লোকের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, যার মধ্যে ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। তামাকের ব্যবহার অনিয়ন্ত্রিত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি বছর এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৮০ লাখ। যার শতকরা ৮০ ভাগ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, তামাকে ৪০০০-এর বেশি ক্ষতিকর পদার্থ আছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ২৫০টি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ৫০টির বেশি পদার্থ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের দিয়ে তামাক চাষ করানো হয়। এসব ছেলেমেয়ে সকালবেলা শিশিরভেজা কুয়াশায় তামাকপাতা নিয়ে কাজ করে, যারা ‘গ্রিন টোব্যাকু’ নামের এক প্রকার অসুখে আক্রান্ত হয়। ভেজা তামাকপাতা নিয়ে কাজ করার সময় নিকোটিন চামড়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষিতের হার বেশি ও সচেতনতার কারণে তামাকের ব্যবহার কমলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। তামাক কোম্পানিগুলোর ব্যাপক প্রচারণা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিরক্ষরতা এর জন্য দায়ী। তামাকের ব্যবহারে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে গিয়ে প্রায় সময়ই ঘাটতি বাজেটের সম্মুখীন হতে হয়। গরিব ধূমপায়ীর আয়ের অংশ তামাকের ব্যবহারে খরচ করার কারণে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা ইত্যাদি প্রয়োজনীত খাতে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। পাশাপাশি তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ থাকে বিধায় চিকিৎসা খরচ তাদের জন্য একটি বাড়তি বোঝা এবং কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণে পরিবারের আয়ের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে ধূমপায়ীর হার শতকরা ৪৩ ভাগ। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারী মহিলার হার ২৮% এবং পুরুষ ২৬%। সিগারেট ব্যবহারকারী পুরুষ ৪৫% এবং মহিলা ১.৫%। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকের কারণে ৫৭০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে এবং ৩৮২০০০ লোক তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে অসুখ ও অক্ষমতাজনিত কুফল ভোগ করতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, তামাকের ওপর শতকরা ১০ ভাগ করারোপ করা হলে উন্নত দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার ৪ ভাগ হ্রাস পায়। অপরদিকে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে তামাকের ব্যবহার হ্রাস প্রায় ৮ ভাগ। অতএব, তামাকের ওপর বেশি হারে করারোপ করা গেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেশি উপকৃত হবে, যা পরবর্তীতে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হবে। বাংলাদেশে তামাকের ওপর কর কাঠামো চার স্তর বিশিষ্ট। সর্বনিম্ন ৪০% এবং সর্বোচ্চ ৬০%। বিড়ির ওপর সম্পূরক কর ফিল্টার থাকা না থাকা সাপেক্ষে ২০% হতে ২৫% পর্যন্ত। গত বছরের বাজেটে সকল প্রকার আমদানি ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তামাকজাত পদার্থের ওপর শতকরা ১ ভাগ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ নির্ধারণের বিষয় বলা ছিল। বাজেটে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ এবং উচ্চতর হারে সারচার্জ নির্ধারণপূর্বক তা আদায় করে চিকিৎসা খাতে খরচ করা গেলে জনগণের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে অবদান রাখবে। ধূমপায়ীর কারণে অধূমপায়ীরা তামাকের বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত নয়। যারা ধূমপায়ী তারা তো নিজেদের এবং পরিবারের ক্ষতি করছেই, ধূমপায়ীদের বেলায় ধূমপানের যে বিষক্রিয়া তা সবই অধূমপায়ীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। একজন ধূমপায়ীর আশপাশে যারা আছে কিংবা থাকে তাদেরও পরোক্ষ ধূমপায়ী হিসেবে বাতাসে বিরাজমান বিষাক্ত পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্য ও আর্থিক ঝুঁকিতে ফেলে। বর্তমানে নন্-স্মোকার্স রাইটস ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয়। বাংলাদেশেও তামাকবিরোধী আইনে অধূমপায়ীর অধিকার সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তামাকবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে সরকারের সবচেয়ে কল্যাণমুখী পদক্ষেপ হলো ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধনী এনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন করা। সংশোধনী আইনে জরিমানার হার ৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা, ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পদার্থ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় আনা, সিগারেটের প্যাকেটে সতর্কবাণী ৫০% রাখা ইত্যাদিসহ আরও নানামুখী পদক্ষেপ, যার যথাযথ বাস্তবায়নে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণা, সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রকাশনা, তামাক-তামাকজাত পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও আইনের বাস্তবায়নসহ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের বিবিধ কাজ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে তামাক চাষের পরিবর্তে আলু, রসুন, মরিচ এবং তুলা চাষ অধিকতর লাভজনক। বিশেষ করে দেশে যখন তুলা আমদানি করতে হয়। তামাকের পরিবর্তে তুলা চাষ করা গেলে একদিকে প্রাণঘাতী তামাকের চাষ কমবে, অপরদিকে তুলা আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকিও কমে আসবে। তামাক কোম্পানি বিভিন্ন কৌশলে জনগণের শুভাকাক্সক্ষীরূপ ধারণ করে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী, হেলথ ক্যাম্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে। এসব কর্মসূচীর আসল উদ্দেশ্য হলো তামাকের বাজার ও বিক্রয় বাড়ানো। এসব কর্মসূচী সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের জন্য একটি সহায়ক শক্তি। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক সময় আইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তারা নিজেরাও সচেতন নন। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয়া যায়, যাতে তারা আইন সম্পর্কে অবগত হয়ে তা বাস্তবায়নে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারেন। সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেক সচেতন নাগরিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী সংগঠন, পরিবারের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তামাকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। লেখক : নির্বাহী সচিব, আধূনিক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক
×