ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

জমজমাট বার্লিন-কার্নিভাল

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৩১ মে ২০১৫

জমজমাট বার্লিন-কার্নিভাল

“ঝলমলে চকচকে তরুণী-যুবতী। পরনে সবুজ শাড়ি। মাথায় টিকলি। ফুল। হাতে মেহেদি। পায়ে ঘুঙুর। গানের সঙ্গে ছন্দোময় নৃত্য। ফুরফুরে হাওয়া। আকাশ ঝকঝকে, দিনের তাপমাত্রা কুড়ি। দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে নাচ, বিরতিহীন। সঙ্গে যুবাকুলও আছেন। পরনে লুঙ্গি। কারুকাজ করা নানা রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় গামছা। যুবতী-যুবার ভূষণে বাংলার আদি রূপ। তাই দেখে...”; চেন্নাইয়ের অর্জুন শ্রীরামাকৃষ্ণান (দক্ষিণ কলকাতার লেক গার্ডেনসে জন্ম। বড়ও হয়েছেন ওখানেই। পড়েছেনও কলকাতায়, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। বন্ধুরা সব বাঙালী। ম্যাক্স ম্যুয়েলার ভবনের প্রাক্তন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এসভি রামণ যেমন দক্ষিণ ভারতের হয়েও বাঙালীর চেয়ে বেশি বাঙালী। বহু বাঙালীর চেয়ে শুদ্ধ বাংলা বলেন।)-এর কথা শেষ হয়নি, পারভিন বিবির মন্তব্য, ‘বঙ্গললনা দেখে কি জার্মান ছোকরাবুড়ো ভিমড়ি খাচ্ছিল? আহা রে! আগে কেন বলেননি।’ রসিকতার মাত্রা ছাড়াতে পারে, আঁচ করে, ছায়াবৃতা বললেন, এবারের কার্নিভাল সত্যিই চোখ ধাঁধিয়েছে অনেকের। আশাতীত ঘটনা। ‘বেঙ্গলিশে কুলটুরফোরুম’-এ (বেঙ্গলি কালচারাল ফোরাম) আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় যোগ দিয়েছে। বার্লিনের বাঙালীরা তো আছেই, এসেছে ফ্রাঙ্কফুর্ট, কোলন, হাইডেলব্যার্গ, মিউনিখ, হ্যানোভার, ন্যুরেমব্যার্গ, ড্রেসডেন, বন এমন কি ডেনমার্ক, বাংলাদেশ থেকেও। আসলে, জার্মানির অন্যান্য শহর-রাজ্যে যে কার্নিভাল, একান্তই আঞ্চলিক। বার্লিনের মতো আন্তর্জাতিক নয়। গত কুড়ি বছর ধরে আন্তর্জাতিকতার যে চরিত্র প্রকাশিত, অন্যত্র দেখা পাওয়া ভার। কেবল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নয়, সঙ্গে উদ্দাম নাচগান, হোক তা কিছুটা বেআব্রু, পোশাকে অশালীন, কিন্তু মনে রাখতে হবে নানা দেশের আদিম তথা ঐতিহ্যবাহী এথনিক কালচারই প্রদর্শন মূল উদ্দেশ্য। আফ্রিকার বহু দেশে নারীরা এখনও কাঁচুলিতে অভ্যস্ত নয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের জয়িতা ওরফে সোমা এবং ওঁর স্বামী মন্টু বললেন, বার্লিনের কার্নিভালে সব দেশের মানুষের একাত্মতা প্রণোদনাময়। প্রতিবছর আসি। যোগ দেই। জয়িতা নারায়ণগঞ্জের। মন্টু বরিশালের। যদিও জার্মান নাগরিক এখন। গুজব নয়, মিডিয়ায় খবর রটেছিল, এ বছরই বার্লিন কার্নিভালের ইতি, হেতু! বার্লিন সিনেটের কালচারাল দফতরের টাকশাল শূন্য, উপরন্তু দেউলিয়া। এই খবরে বার্লিন-কার্নিভালপ্রেমীদের হাহাকার। জার্মানির বিভিন্ন রাজ্য থেকে মানুষের ঢল। কোন হোটেলে ঘর ফাঁকা নেই। হ্যারমান প্লাতস থেকে মেরিংডাম, পাঁচ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে তিল ধারণের জায়গা নেই, সাত লাখের বেশি দর্শক। এর মধ্যে আবার নানা খাবার, পানীয়ের স্টলও। ত্রিনিদাদের এক ডাবের দাম পাঁচ ইউরো (ডাবের মধ্যে হাফ লিটারেরও অর্ধেক জল। পিপাসিতের দীর্ঘ লাইন।) ভারতীয় রেস্তরাঁ আরমানে (মালিক বাংলাদেশের মোস্তাক) আধঘণ্টা অপেক্ষার পরও যদি জায়গা পাওয়া যায়, খাদক নিশ্চয় ভাগ্যবান। কি কারণে অজানা, এবার, বার্লিনের কার্নিভালে দেশের সংখ্যা কম, মাত্র ৬৪। গত বছরেও ছিল শতাধিক। গোটা ভারত এককভাবে অংশ নেয়নি কখনও। ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেই। তামিলনাড়ু ভারতকে রিপ্রেজেন্ট করে না। ভারতীয় তামিলের যে শোভাযাত্রা, পোস্টার-প্ল্যাকার্ডে বড় বড় হরফে লেখা : জুডইন্ডিয়েন তামিল (দক্ষিণ ভারতীয় তামিল)। ...হ্যাঁ, ভারতীয় দল আছে বৈকি, নাম ইসকন। রথে (খোলা ট্রাক) জগন্নাথের নানা রূপচেহারা। ইসকনিদের পরনে শাদা-গেরুয়া শাড়ি-ধুতি। কণ্ঠে ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’। এই কলিতেই ধেই ধেই উদ্বাহু নেত্য। ফ্রাঙ্কফুর্টের জয়িতা ওরফে সোমার কথা ভাববার। তিনি বলছেন, কার্নিভালে দেশকে, দেশের এথনিক কালচারকে তুলে ধরা হয়, পোশাকসহ নানা ঐতিহ্যে, আঙ্গিকে, এও এক পর্যটনের প্রদর্শনী। এই প্রদর্শন বিজ্ঞাপিত করতে পারে সরকার, সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়। এর জন্য যদি বাড়তি খরচ করে, দেশ থেকে হরেক কিসিমের শিল্পী পাঠায়, যারা দেশীয়-এথনিক কালচার তুলে ধরবে, যা দেখে টুরিস্ট আকৃষ্ট, টুরিজম-ব্যবসা হবে আরও লাভবান। আদম আলীর কণ্ঠ : হেই বুদ্ধি যদি দুই বঙ্গের লাঠলাঠির (প্রধানমন্ত্রী/মুখ্যমন্ত্রী) হইতো, দ্যাশে বহুত টুরিস্ট খাবি খাইতো। চিত্রাঙ্গদা। বার্লিনের কার্নিভালে দুই বাংলার মানুষ এতটা নিবিড়, এতটা আপন, এতটা ঘরের, বিভক্ত দেশ, বাংলা মনেই হয় না। বোকাসুর মোল্লা। ক্যামনে হইবো। এইবার কার্নিভালে বহুত সিকিউরিটি। পুলিশ ছাড়াও শাদা কাপড়ে। আইএস, বোকো হারামিরা যাতে হান্দায়তে না পারে, নজর রাখছে। আদম আলী। বার্লিনের কার্নিভাল লইয়া ডয়েচিরা ফুটানি মারে, বাঙালীরা ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ গান গায়, গানের লগে ড্যান্স মারে। অর্জুন শ্রীরামাকৃষ্ণান। বার্লিনের খোলা রাস্তায় লাখ-লাখ মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা গান, মাইকে তারস্বরে বাজছে, এও অভাবনীয়। কেবল একটি গান নয়, কুড়ি-পঁচিশটি। এমন গান, যে গানের সঙ্গে তালবেতাল নাচও মানানসই। তবে পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে জমেনি। নাচও অরাবীন্দ্রিক। অবশ্য, দর্শকরা লুফে নিয়েছে খুবই। সবুজ শাড়ি পরে নাচিয়েরা বাংলার রূপকেই যেন ফুটিয়েছে। আদম আলী। ঝকঝকে-চকচকে রোদ, ফুরফুরে হাওয়া, বাদল আইলো কই ত্যান? রোকেয়া। ছোটখাটো ভুল ধরবেন না। উন্মুক্ত আকাশের নিচে, খোলা চত্বরে, বিশ্বের নানাদেশের এথনিক কালচারে, লোকে যাকে বলে বিশ্ব সংস্কৃতির সম্মিলন, বিশ্ব-ডিস্কো ড্যান্সে তালবেতাল ধর্তব্য নয়। দীপক হালদার। বার্লিনের কার্নিভালে স্ট্রিট ড্যান্স, শোভাযাত্রা, নারী-পুরুষের পরনে দেশীয় এথনিক সাজপোশাক কেবল একদিন প্রদর্শিত। কিন্তু মূল কার্নিভাল চারদিনের। শুক্রবার থেকে শুরু, সোমবারে শেষ। কার্নিভালের আসল জায়গা হালেসেস টোরে, মেট্রোরেল স্টেশন সংলগ্ন বিশাল ময়দানে। নানা দেশের গান বাজনা নাচ। হরেক রকম পোশাক, তৈজস বিক্রি। গোটা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য য়েন হাজির। বাহারি সব জিনিস। খাবারের স্টল। ভারত, বাংলাদেশেরও। আদম আলী। বাংলাদ্যাশ, ইন্ডিয়ার স্টলে আর খামু না, ঝাল নাইক্যা। পিঁয়াজু দিয়া কয় স্যুইবেল (পিঁয়াজ) কাটলেট, মাইয়ারা কলাপাতা শাড়ি পইরা হাস্যমুখে খাদকরে ডালের বড়া দ্যাখাইয়া কয় লিনসেন কাটলেট। খাদ্যাখাদ্যে এও এক ভেল্ট কুলটুর (বিশ্ব সংস্কৃতি)।
×