স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মজয়ন্তী পেরিয়ে গেছে গত সোমবার। তবে দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার এই কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন চলছে এখনও। শুক্রবার জ্যৈষ্ঠের সন্ধ্যায় তাঁকে স্মরণ করল ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। আর ছায়ানট বলেই স্বভাবতই আয়োজনেও ছিল নজরুলের সৃষ্টির ঐশ্বর্যময়তা। কবিরই সৃষ্ট অবিনাশী গানের সুরে, জাগিয়ে তোলা কবিতার শাণিত উচ্চারণে, সুরাশ্রিত নাচের মুদ্রায় কিংবা বক্তার বন্দনায় ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন হয়ে ওঠে নজরুলময়। হৃদয়স্পর্শী রকমারি পরিবেশনায় জাতীয় কবিকে জানানো হয় অশেষ অঞ্জলি। আর এমনই স্নিগ্ধতামিশ্রিত বর্ণিল রূপে শুরু হলো ছায়ানটের দুই দিনের নজরুল উৎসব। পরিবেশিত হলো অতিথি এবং ছায়ানটের শিল্পীদের একক গান, আবৃত্তি, পাঠ ও দলীয় নৃত্যে। সঙ্গে ছিল সুরসপ্তকের সম্মেলক সঙ্গীত।
ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ছয়টা ত্রিশ মিনিটের শুরু হলো উদ্বোধনী পর্ব। ভেসে এলো নজরুলের গানের সুর। সম্মেলক কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা গাইলেন সৃজন ছন্দে আনন্দে নাচো নটরাজ/হে মহাকাল প্রলয়-তাল তোলো তোলো। সেই সুরের সঙ্গে পরিবেশিত হয় বৃন্দ নৃত্য। সম্মেলক নৃত্য-গীত শেষে স্বাগত কথনে অংশ নেন সংগঠনের সহ-সভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলী। আর উৎসব উদ্বোধন করেন শিল্পী এস এম আহসান মুর্শেদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল।
স্বাগত কথনে সারওয়ার আলী বলেন, সপ্তমবারের মতো এই উৎসব করছে ছায়ানট। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছিলেন প্রেম, নিসর্গ ও দ্রোহের কবি। অসাম্প্রদায়িক এই চেতনার এই কবির গান-কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যুগিয়েছে প্রেরণা। অথচ একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধর্মের দোহাই দিয়ে এদেশে পুড়িয়ে মারাসহ মানুষের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। এই ক্রান্তিলগ্নে নজরুলের বড়ই প্রয়োজন। তাঁর গান-কবিতার আশ্রয়ে আরেকটি নতুন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে
আমাদের। উদ্বোধকের বক্তব্যে ছায়ানটের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা তুলে এস এম আহসান মুর্শেদ বলেন, ১৯৬৩ সালে ২৮ বছর বয়সে শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলাম এই প্রতিষ্ঠানে। এখন আমার বয়স ৮০ বছর। আজ আমাকে নজরুল উৎসবের উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোয় ঋণী হয়ে রইলাম ছায়ানটের কাছে।
খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সমাজ গঠন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মুসলিম জাগরণÑ এমন আদর্শকে একসঙ্গে ধারণ করে নজরুল হয়েছেন মহীয়ান। নজরুল প্রজন্মের শিল্পীরা তাঁর সেই আদর্শকে ধারণ করে এগিয়ে চলবে।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় পরিবেশনা পর্ব। আমি গগনে গহনে গানটি শোনান শ্রাবন্তী ধর। ধ্রুব সরকারের কণ্ঠে গীত হয় ধূলি-পিঙ্গল জটাজুট। জান্নাত-ই-ফেরদৌসী লাকী গেয়ে শোনান সুরে ও বাণীর মালা। এছাড়াও নজরুলের অবিনাশী বাণী ও সুরে একক কণ্ঠে গান শোনান স্বর্ণা নাগ, ফাহ্ইমদা রহমান, নাহিয়ান দূরদানা শুচি, সুমন চৌধুরী, জারিফ ইকরাম, রিফাত আরা তমা, ঐশ্বর্য সমাদ্দার, লায়েকা বশির, খালিদ হোসেন, ড. নাশিদ কামাল, ফারহানা আক্তার, ইয়াকুব আলী খান, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, ডালিয়া নওশিন, ইয়াসমিন মুশতারী, লতিফুন জুলিও, কানিজ হুসনা আহম্মদী, সঞ্জয় কবিরাজসহ একঝাঁক শিল্পী। তাঁদের পরিবেশিত কয়েকটি গানের শিরোনাম ছিলÑ যাক্্ না নিশি গানে গানে, তব মুখখানি, মোর প্রথম মনের, জানি জানি প্রিয়, গভীর রাতে জাগি, ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান ও প্রথম প্রদীপ জ্বালো।সংঘ শরণ তীর্থযাত্রা ও রুমঝুম্্ রুমঝুম্্ কে বাজায় শীর্ষক দুটি সম্মেলক সঙ্গীত পরিবেশন করে সুরসপ্তক। নজরুলের রচনা থেকে পাঠ করেন সুমনা বিশ্বাস। তোরা সব জয়ধ্বনি কর এই গানের তালে ছায়ানটের শিল্পীদের সম্মেলক নৃত্য-গীতের মাধ্যমে শেষ হয় প্রথম দিনের উৎসব।
আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা ছয়টায়। এদিন নজরুল স্মারক বক্তৃতা করবেন অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ। সাংস্কৃতিক পর্বে হিন্দোলের সম্মেলক গান আর নৃত্যদল নৃত্যনন্দনের পরিবেশনা। সেই সঙ্গে উপস্থাপিত হবে অতিথি এবং ছায়ানটের শিল্পীদের এক গান, আবৃত্তি ও পাঠ।
ভিক্টর মঙ্গের গিটারের সুরে সিক্ত শ্রোতা ॥ গিটারের অনবদ্য সুরধ্বনিতে শ্রোতাদের সিক্ত করলেন স্প্যানিশ গিটারশিল্পী ভিক্টর মঙ্গে। বাজিয়ে শোনালেন স্পেনের লোকসঙ্গীতের বিশেষ ধারা ফ্লেমেনকো। আঙুলের অনবদ্য ছোঁয়ায় গিটারের ছয় তারের টোকায় উপস্থাপন করলেন ফ্লেমেনকোর রকমারি পরিবেশনা। আর সেই অনবদ্য সুরের মায়াজালে সিক্ত হলো শ্রোতাকুল। শুক্রবার সন্ধ্যায় সুরেলা শব্দধ্বনিতে আচ্ছন্ন হলো শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় সেরানিতো শীর্ষক এ সঙ্গীতসন্ধ্যার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। আর সুরের আকর্ষণে আসা শ্রোতাদের উপস্থিতিতে মিলনায়তন ছিল পরিপূর্ণ। ভিড় জমিয়েছিলেন এদেশে থাকা ভিনদেশী সঙ্গীতানুরাগীরাও।
সুরের এ আয়োজনে ছিল না কোন বক্তৃতার বিড়ম্বনা। তাই শুরুতেই স্বপ্ন বুনে যাওয়ার ছয় তারে তিনি পরিবেশন করেন ফ্লেমেনকোর একটি গভীর ও আকর্ষণীয় ধারা ‘তারান্তা’। স্প্যানিস লোকসঙ্গীতের অন্যতম সমৃদ্ধ ধারা। যা কথা বলে মাটির গভীর খনিতে করা কঠোর পরিশ্রমের কথা বলে।
মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ কবি অনিল সরকার স্মরণ ॥ উত্তর ভারতের প্রধান বাঙালী কবি অনিল সরকার। কবির পরিচয়কে ছাপিয়ে একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সুহৃদের আরেক পরিচয় তিনি ছিলেন ত্রিপুরা সরকারের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী মুক্তির সংগ্রামে সুহৃদ ছিলেন। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কীর্তিমান মানবদরদী এই মানুষটি। সেই সূত্রে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে শুক্রবার স্মরণ হলো এই আলোকিত কবিকে। গানের সুরে, বক্তার কথায় ও কবিকণ্ঠের কবিতায় জানানো হলো শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ শোকসভার আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি।
নজরুলজয়ন্তীর আবৃত্তি প্রযোজনা রুদ্রবীণা ॥ সংস্কৃতিচর্চায় স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আবৃত্তি এখন উজ্জ্বলতম স্বতন্ত্র এক শিল্প মাধ্যম। সেই উজ্জ্বল ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হলো আবৃত্তি প্রযোজনা রুদ্রবীণা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবির কবিতায় সাজানো প্রযোজনাটি পরিবেশন করে স্বরচিত্র আবৃত্তিচর্চা কেন্দ্র।