ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে, আতঙ্কে নারী ও শিশু

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩০ মে ২০১৫

ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে, আতঙ্কে নারী ও শিশু

শর্মী চক্রবর্তী ॥ দেশজুড়ে নারীর প্রতি পাশবিক নির্যাতন, সহিংসতা ও নৃশংতা বেড়েই চলছে। পাশবিক নির্যাতনের পরে কোথাও কোথাও অনেক নারীকে হত্যা করা হচ্ছে। অনেক সময় পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করে লাশ গুম করারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে নারীরা প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারীদের সুরক্ষায় দেশে নানা আইন থাকলেও সেসব আইন কোন কাজে আসছে না। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সমাজের সব স্তরের নারী কোন না কোনভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, তাঁরা নিজ ঘরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতনকারীর ভূমিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষকেই দেখা যায়। ঘরেই নারীরা বাবা, ভাই ও স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন। ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নিরাপত্তাহীন। ধর্ষণ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেমের প্রস্তাবে বা বিয়েতে রাজি না হলে নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ছুড়ে মারা হচ্ছে এ্যাসিড। ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোট শিশুরাও। মুঠোফোনে ধর্ষণের ছবি তোলা বা ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে। অনেক সময় ধর্ষণের পর হত্যাও করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও অনেক সময় বিচার হয় না। প্রকাশ্যে এসব ঘটনায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ভয় ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে নারীদের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবে জীবধারণ করতে পারবেন কি না তা নিয়ে শঙ্কায় গোটা নারী সমাজ। এই ভয়াবহতা দিনের পর দিন বেড়ে চলছে। এর কারণ কোন ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হইচই হয়, আলোচনা হয়, তারপর অন্য ঘটনার পেছনে তা চাপা পড়ে যায়। এই ধারা চলতে থাকায় অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে বলে মনে করেন নারী নেত্রীরা। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে এক দল যুবক নারীদের ওপর চড়াও হয়। সে সময় চার নিপীড়ককে ধরে পুলিশের কাছে দেয়া হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়, যা পুলিশও স্বীকার করেছে। ওই ঘটনায় এক মাসেও কাউকে গ্রেফতার করতে না পেরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সিসিটিভির ফুটেজ থেকে আট সন্দেহভাজন নিপীড়কের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে মোহাম্মদপুর প্রিপ্যারেটরি স্কুলে এক শিক্ষার্থীকে ‘যৌন হয়রানি’র অভিযোগ ওঠে। এর তদন্ত নিয়ে টালবাহানার অভিযোগে অভিভাবকরা বিক্ষোভ শুরু করলে গত ১৬ মে উপাধ্যক্ষকে অব্যাহতি দেয় কর্তৃপক্ষ। এর কিছুদিন পরই রাজধানীতে অস্ত্রের মুখে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে গারো তরুণীকে গণপাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পাঁচ দিন পর এই ঘটনায় জড়িত তুষার ও চালককে আটক করে র‌্যাব। শুধু মাইক্রোবাসেই নয়, বাড়িতে গাড়িতে ট্রাকে রাস্তায় নারীর ওপর এমন পাশবিকতায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নারী সমাজ। ঘরে-বাইরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নারী ও শিশু। তবে এ সব ঘটনায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন ভুক্তোভোগীরা। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে দুর্বৃত্তরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ফলে একের পর এক ঘটছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, অপরাধীদের চিহ্নিত ও আটক করতে তৎপর রয়েছেন তারা। মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে ১৫৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৬১ জন নারী ও ৯৩টি শিশু। চলতি বছরে গণধর্ষণের শিকার ৭৬ জনের মধ্যে ৩৯ জনই শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জনকে। ধর্ষণের পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে দুই নারী ও শিশু। আর গেল বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ৬৬৬ নারী-শিশু। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলে দাবি করেন অনেকে। মানবাধিকার, সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা বলছেন, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী লাঞ্ছনা নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা যাদের দায়িত্ব, অনেক সময় দেখা যায়, তারাই তাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। কখনও কখনও অপরাধীরা রাজনৈতিক মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। ফলে একের পর এক নৃশংসতা পাশবিকতা বেড়ে চলছে। গত ৯ মে মানিকগঞ্জে এক শিশুকে (১১) দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণ করেছে। এছাড়াও ধর্ষণের দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ধারণ করা হয়েছে। শিশুটির পরিবার মোবাইল ফোনে ধারণ করা ধর্ষণের এ ভিডিও ক্লিপ দুই সপ্তাহ পর অন্য বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পেরে ঘিওর থানায় মামলা করেন। আসামিরা হলেন- ওই গ্রামের গণি মল্লিকের ছেলে শাহীন মল্লিক (২০) ও দবির মল্লিকের ছেলে রমজান মল্লিক (২০)। শিশুটির পরিবার জানায়, ৯ মে বিকেলে শাহিনের বাড়ির পাশ দিয়ে ওই শিশু একই গ্রামে তার নানাবাড়ি যাচ্ছিল। এ সময় শাহীন শিশুটিকে ফুঁসলিয়ে নিজ ঘরে নিয়ে সাউন্ড বক্সে গান বাজানো শুরু করেন। এক পর্যায়ে শাহীন শিশুটির মুখ চেপে ধরে তাকে ধর্ষণ করে। শিশুটি আর্তচিৎকার করলেও উচ্চ শব্দে গানের কারণে আশপাশের লোকজন তা টের পায়নি। পরে শাহীন তার অপর বন্ধু রমজানকে মোবাইল ফোনে বাড়ি ডেকে আনে। রমজান এসেও শিশুটিকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের এ ভিডিও ক্লিপ শাহীন নিজ মোবাইল ফোনে ধারণ করে। এরপর তারা ধর্ষণের ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলা হবে বলে শিশুটিকে হুমকি দেয়। শিশুটিও ভয়ে স্বজনদের কাছে না বলে বিষয়টি চেপে যায়। শিশুটির বাবা জানান, এ ঘটনার দুই সপ্তাহ পর শাহীনের মোবাইল ফোন থেকে গান নিতে গিয়ে তারই বন্ধু একই গ্রামের রায়হান ও হৃদয় ধর্ষণের ভিডিও ক্লিপটি দেখতে পায়। এর পরই বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। ২১ মে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় অস্ত্রের মুখে গারো এক তরুণীকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর গাড়িতেই ওই তরুণীকে গণধর্ষণ করে রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরার জসীমউদদীন রোডের মাথায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ গড়িমসি করে। শুক্রবার দুপুরে এ ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণী। এরপর গত ২৩ মে শনিবার তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসায় ধর্ষণের আলামত পায় ফরেনসিক বিভাগ। এছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষা ও চিকিৎসা শেষে ওই তরুণীকে গত রবিবার তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনার ঠিক দুই দিন পরে গত শনিবার রাতে গাজীপুরে নেশাযুক্ত কোমল পানীয় (ফানটা) পান করিয়ে ট্রাকচালক এক নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই নারী জানান, তিনি রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ডাক্তার দেখিয়ে তার স্বামীকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলেন। বাস না পেয়ে অনেকক্ষণ পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে এক ট্রাকচালক তাদের সামনে দাঁড়ায়। তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব দিলে রাজি হয় চালক। এ সময় তারা স্বামী-স্ত্রী চালকের পাশে বসেন। গরমের মধ্যে পথে চালক তাদের ফান্টা খাওয়ায়। এর কিছুক্ষণ পরই তাদের ঘুম ঘুম ভাব দেখা দেয়। এ সময় চালকের কথা মতো ওই নারীর স্বামী পেছনে ওপরের সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে ট্রাক চালক গাড়ি থামিয়ে অস্ত্রের মুখে মারধর করে ও গলায় কাপড় পেঁচিয়ে তাকে ধর্ষণ করে এবং মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে থাকে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু থানায় অভিযোগ করে না। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা না থাকা এবং জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতার অভাব ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ। নারীরা এখন কোথাও নিরাপদভাবে চলতে পারছে না। বর্তমান ঘটনাগুলোতে সবার মধ্যে ভয় বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম সুরক্ষার নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এজন্য অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভালো ভালো আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। বর্তমানে দেশের নারীরা কর্মক্ষেত্র-শিক্ষাক্ষেত্র কোথাও নিরাপদ নয় বলে এক মানববন্ধনে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নারীর নিরাপত্তা বিধান করতে না পারে, তবে সেটার জবাবদিহি করতে হবে। সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে প্রমাণ করতে চাইলে অনতিবিলম্বে ধর্ষণে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার পেছনে একটি বড় কারণ হচ্ছে নির্যাতনকারীর শাস্তি না হওয়া। নারী নির্যাতন-সংক্রান্ত কোন মামলা হলে তা বছরের পর বছর পড়ে থাকে। যেখানে ১০০ দিনের মধ্যে বিচার হওয়ার কথা, সেখানে দেখা যায় পাঁচ থেকে ১০ বছর লেগে যাচ্ছে। যে মামলা দায়ের করেন তিনি নিজেই আশা হারিয়ে ফেলেন। বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে নির্যাতনের ঘটনা ঘটার সুযোগ পাচ্ছে। বিচার দ্রুত হলে এবং মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হলে ঠিকই নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন কমে যেত। বর্তমানে পরপর ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটেছে বেশিরভাগ অপরাধীই জানে না ধর্ষণের মামলায় তার কি বিচার হতে পারে কারণ বেশির ভাগই গাড়ির ড্রাইভার হেলপাররা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। তারা পত্রিকা পড়ে না আইন জানে না তাই বারবার এই অপরাধ করছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। এলিনা খান আরও বলেন, নারীর প্রতি নির্যাতন বাড়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, কোথাও কোন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে না বা পুলিশকে খবর দেয় না। যারা নারী নির্যাতনের ঘটনা জেনেও চুপ করে থাকে, তাদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য প্রচলিত আইনগুলোর পরিবর্তন করতে হবে।
×