ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীর খোলা জায়গা কমছে;###;উচ্ছেদে কঠোর ব্যবস্থা নেই;###;প্রভাবশালীরাই মূল হোতা

বেপরোয়া দখলবাজি

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৩০ মে ২০১৫

বেপরোয়া  দখলবাজি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীজুড়ে রাস্তা, ফুটপাথ আর খেলার মাঠ দখলের মহোৎসব চলছেই। রাস্তা আর ফুটপাথজুড়ে বসেছে হাজার হাজার দোকান। বেপরোয়া দখলবাজরা। মূলত প্রভাবশালী গোষ্ঠীই এর মূল হোতা। এ কারণে দিন দিন বাড়ছে জনদুর্ভোগ। কমছে খোলা জায়গা। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের বাইরে চলে যাচ্ছে পার্কসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দখল উচ্ছেদে কঠোর ভূমিকা রাখতে পারছেন না নির্বাচিত মেয়ররা। দুই সিটিতে প্রায় ৬৮টি খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে। এর মধ্যে গেল এক দশকে দখলে গেছে অন্তত ১২টি মাঠ ও শিশু পার্ক। দুই সিটিতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাথই এখন অবৈধ দখলে। আর ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রয়েছে বেদখল। এদিকে দখল উচ্ছেদে কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিরা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৩ সালের ২৪ নবেম্বর স্থাপিত হয় আজিমপুর শিশু পার্ক। এ পার্কের বেশিরভাগ স্থান দখল করে গড়ে উঠেছে দুটি ভবন। আর একটি অংশ দেয়া হয়েছে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে। পার্কটির মাঝের অংশে স্থাপন করা পানির পাম্পের সাইনবোর্ডে এখনও শিশু পার্ক কথাটি লেখা আছে। আরমানিটোলা খেলার মাঠের চারপাশজুড়ে দখলের চেষ্টা চলছে দীর্ঘদিন। ইতোমধ্যে মাঠের জমির কিছু অংশ বেহাত হয়েছে। তোলা হয়েছে ঘরবাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এক সময়ের আরমানিটোলা মাঠ এখন আর নেই। গেল চার দশকে মাঠের চার ভাগের এক অংশ প্রভাবশালীদের দখলে গেছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান লুপ থেকে রাস্তায় নামতে যানবাহন আর যাত্রীদের দুর্ভোগ যেন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ফ্লাইওভারের নিচেই রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে হাজারো দোকান বসেছে। অপরিকল্পিতভাবে রাখা আছে বিভিন্ন গন্তব্যের বাস। অথচ এটা নির্ধারিত কোন টার্মিনাল নয়। এমন চিত্র মিলবে গোটা রাজধানীজুড়েই। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর উদ্যোগে গুলিস্তানসহ নগরীর একাধিক এলাকার ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করা হলেও এক সপ্তাহের ব্যবধারে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে সবকিছু। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হক জনকণ্ঠ’কে বলেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে আমরা কাজ শুরু করেছি। ২৬ মে থেকে রাস্তা, ফুটপাথ, পার্কসহ খেলার মাঠ দখল উচ্ছেদের বিষয়টি দৃষ্যমান হবে। নবনির্বাচিত মেয়র জনস্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচী প্রণয়ন করছেন। আমাদের কাজ হবে নগরবাসীকে শান্তি ও স্বস্তি দেয়া। নাগরিকের সকল অসুবিধা দূর করা। দখল হয়ে গেছে ৯ শিশু পার্ক ॥ রাজধানীর বকশীবাজার, লালমাটিয়া নিউ কলোনি, মতিঝিল বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড এলাকা, সায়েদাবাদ, আজিমপুর, উত্তরা সেকশন-১, মিরপুর সেকশন-১ ও ২ এবং কাওরানবাজার এলাকায় স্থাপিত শিশু পার্কগুলোর এখন কার্যত কোন অস্তিত্ব নেই। এছাড়া আরও অনেক পার্ক অবৈধ দখলে চলে গেছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, একটি আদর্শ নগরীর তুলনায় আমাদের এ শহরের পার্কের অবস্থান একেবারেই কম। আবার যেগুলো আছে সেগুলো দখলে মেতে উঠেছে একটি চক্র। বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন পার্কটি অনেক সরঞ্জাম বসিয়ে স্থাপিত হয় ১৯৮৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। ২০০০ সাল থেকে এটি দখল হতে থাকে। বর্তমানে এতে অনেক ছাপড়া ঘরসহ অনেক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। মতিঝিল বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন পার্কটির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ পার্কটির স্থানে এখন বিআরটিসির স্থাপনা, ফায়ার সার্ভিসের অফিস ও বাসমতি নামের একটি রেস্তরাঁ। ডিসিসির মাঠগুলোও অস্তিত্বহীন ॥ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে আছে ৫৪টি পার্ক ও ২৫টি খেলার মাঠ। এর মধ্যে উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২৯টি পার্ক ও ১৫টি খেলার মাঠ। আর দক্ষিণে রয়েছে ২৫টি পার্ক ও ১০টি খেলার মাঠ। সার্বজনীন ব্যবহারের জন্য গড়া মাঠগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দখল করে নিয়েছে। আবার কোথাও সরকারী কর্মকা-ের কথা বলে ব্যবহার করে চলেছে ডিসিসি নিজেই। উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরের বড় মাঠটি হয়ে গেছে ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠ। গুলশানের সার্বজনীন মাঠটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে ইয়ুথ ক্লাব। কাওরানবাজারে কাগজে-কলমে আছে আধা একরেরও বেশি আয়তনের একটি শিশুপার্ক। অথচ সেখানে ঝুলছে ‘কাওরান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাইনবোর্ড। চারপাশজুড়েই বসছে দোকানপাট। মহল্লা পর্যায়ে খেলার জায়গা হিসেবে যেটুকু ফাঁকফোকর আছে তাও পরিণত হয়েছে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। পাশাপাশি দিনদুপুরে চলে নেশাখোরদের আড্ডা। সন্ধ্যার পর চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। মাঠজুড়ে রাখা আছে ভ্যান। সাধারণ মানুষের প্রবেশ, বিশ্রাম কিংবা খেলাধুলার কোন সুযোগ নেই মাঠে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি আদর্শ নগরীর মোট আয়তনের ২৫ ভাগ সড়ক থাকা আবশ্যক। আছে আট ভাগেরও কম। খিলগাঁওয়ের তিলপাড়া মাঠটিও বেহাত হয়েছে। খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন খেলার আনসার বাহিনীর দখলে চলে গেছে আট বছরের বেশি সময় আগে। রাস্তা ও ফুটপাথের চিত্র ॥ গুলিস্তানের কোন রাস্তা ও ফুটপাথ দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই। মানুষের যাতায়াতের জন্য এসব নির্মাণ করা হয়েছে। যতদূর চোখ যাবে, দোকান আর দোকান। খোদ নগর ভবনের সামনের রাস্তায়ও বসেছে অবৈধ দোকানপাট। সিটি কর্পোরেশনের কর্তা-ব্যক্তিরা বলছেন, ফুটপাথ আর রাস্তা দখল করে চলছে বাণিজ্য। বিভিন্ন পণ্য বেচাকেনা থেকে কমিশন পান ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। এর ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ক্ষমতা পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় শুধু টাকা নেয়া ব্যক্তিদের। মূলত রাজনৈতিক কারণেই ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করা সম্ভব হয় না। হয়ত যে কোন নাগরিকের প্রশ্ন হতে পারে? কোথায় দোকান নেই। দখলের আওতামুক্ত কোন সড়কটি। হয়ত এমন প্রশ্নের জবাব দেয়ার কিছুই থাকবে না। সরেজমিন দেখা গেছে, পুরানা পল্টন থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের ফুটপাথ কোথাও ফাঁকা নেই। এই অংশের পুরো বাস্তার প্রায় অর্ধেক আবার দখলে। টিকাটুলি পুলিশ বক্স থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত ফুটপাথসহ রাস্তার চিত্র একই। তবে এখানে ভিন্নতা হলো মতিঝিল এলাকায় রাস্তায় শত শত প্রাইভেটকার ও নিউ ভিশন বাস থেকে শুরু করে অসংখ্য সিটি সার্ভিস পার্কিং করে রাখা হয়। মাছের রাজার, ফলের দোকান, পোশাক, প্রসাধনী, চশমা, সবজি ও খাবারের দোকান থেকে শুরু করে সব কিছুই যেন হাতের নাগালে এই রাস্তায়। আমিন কোর্টের পেছনের রাস্তাটি অর্থাৎ দৈনিক বাংলা পর্যন্ত পুরোটাতেই রাস্তায় বসেছে খারারের হোটেল। শাপলা চত্বর থেকে কাকরাইল, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে নতুন বাজার পর্যন্ত রাস্তাটির চিত্র একই। এই অংশের রাস্তার দু’পাশের ফুটপাথ ও রাস্তাজুড়ে পোশাক, জুতোর দোকান, বাঁশ, অবৈধ গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে সবকিছুই আছে। মিরপুর ১-১০ নম্বর পর্যন্ত রাস্তার চিত্র একই। মালিবাগ মোড় থেকে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত রাস্তা আর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার কোন উপায় নেই। বাহারি পণ্যের দোকানে এ সড়কে চলা দায়। গোলাপবাগ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী সড়কে অবৈধ বাজার, মাছের আড়ত, রাস্তা দখল করে গাড়ি রাখার চিত্র প্রতিদিনের। ধোলাইখালে পুরনো গাড়ির সরঞ্জাম দিয়ে বন্ধ ফুটপাথ। মহাখালী, বনানী এলাকার রাস্তায় পণ্য বেচাকেনার হাট ২৪ ঘণ্টাই আছে। গুলশান ১ ও ২ নম্বর গোল চত্বর এলাকাতেও রাস্তা দখলের চিত্র নতুন কিছু নয়। শাহবাগ, ফার্মগেট, নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত, ধানমি-, মিরপুর সড়ক, মোহাম্মদপুর, কাওরানবাজার, তেজগাঁওসহ আশপাশের প্রায় সব সড়কেই জুতো, পোশাকসহ হরেক রকম পণ্যের পসরা। আসাদগেট থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দূরপাল্লার বাস পার্কিং করে রাখায় যানজট লেগেই থাকে। কাওরানবাজার থেকে গ্রিন রোড-ফার্মগেট, বসুন্ধরার সামনে নিয়ে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত রাস্তাটি এখন দুর্ভোগের অপর নাম। রাস্তা দখলে থাকায় দুর্ভোগ দিন দিন আরো বাড়ছে। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ ॥ মাঠ-পার্ক-উদ্যান রক্ষায় হাইকোর্টের রুল, কঠোর নির্দেশ-কোন কিছুই যেন পাত্তা পাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার ৬৮টি খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য সংরক্ষিত জায়গা ১৫ দিনের মধ্যে দখলমুক্ত করার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ সময়ের মধ্যে এসব মাঠ, খোলা জায়গা ও পার্কের সীমানা চিহ্নিত করতেও নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে আদালতে দাখিল করার জন্য রাজউক ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
×