ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তৃপ্তি বালা

বিদ্বেষ নয়, প্রয়োজন ভালবাসার সহাবস্থান

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৩০ মে ২০১৫

বিদ্বেষ নয়, প্রয়োজন ভালবাসার সহাবস্থান

এই যে ‘ধর্ষণ’, নির্যাতন, শ্লীলতাহানি- নারীর প্রতি চূড়ান্ত অপমান-অবমাননাকর আচরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে, এর প্রতিকার কী? সমাজ দেশ রাষ্ট্র কী করে এর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে? আইন-আদালত, জেল-জুলুম, ভয়-ভীতি কোন কিছুতেই তো কিছু হচ্ছে না। দিন দিনই বরং এর প্রবণতা, ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। সত্যি বলতে কি, এ তো আর এককভাবে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়, সামাজিক আর সব বিষয়ের সঙ্গে সার্বিকভাবে সম্পর্কিত একটি বিষয়ই। প্রতিদিন চলতি পথে, পত্র-পত্রিকায়, সংবাদমাধ্যমে যা সব ঘটনার সাক্ষাত ঘটে তা এককথায় সভ্যতার জন্যই লজ্জাকর। সত্যি বলতে, সভ্য তো আমরা নই। তাবৎ বিশ্বের সব যান্ত্রিক উন্নয়ন-কারসাজির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কিংবা তার চেষ্টার নাম তো আর সভ্যতা নয়। সভ্যতার মূল যে মানুষ, তার বিকাশ, শিক্ষা-রুচি, মনের আলোক প্রাপ্তিÑ এসবই তো সভ্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি। তাই যদি হয়, তবে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সভ্যতার বিচারে আমরা দেশ-মানুষজন ঠিক কোন্ জায়গাতে অবস্থান করছি। নারীর সৌন্দর্য, সাজ প্রকৃতির মতোই সুন্দর সাবলীল। প্রকৃতির গর্ভজাত কোন মানবসন্তানের সাধ্য কি বা সম্ভব কি করে তার অমর্যাদা, উৎপাটন কিংবা আসুরিক প্রক্রিয়ায় ছিন্নভিন্ন করা? জনাকীর্ণ লোকালয়ে কিংবা নিভৃত গহ্বরে পাশবিক প্রক্রিয়ায় নারীর ধ্বংস লিপ্সায় উন্মত্ত হওয়া কোন মানবসন্তানের পক্ষে স্বাভাবিক কর্ম নয়। জাগতিক বোধবুদ্ধি বিকাশের ধারায় এ তো অনস্বীকার্য যে, শিল্পের চিরন্তন সুষমার উপলব্ধি মানব মনে এবং প্রকৃতিই তার আদি পাঠাগার। নারী এবং পুরুষ প্রকৃতির দুই অনিবার্য মানবসত্তা। প্রকৃতিতে এই দুই রূপের সুষম সহাবস্থান, ইন্টারএ্যাকশান তথা কর্মযোগের মধ্য দিয়েই তো জীবন অর্থপূর্ণ, আনন্দময়। মানব বিশ্বে সমস্ত শক্তি, প্রেরণা ও কর্মের মূলেই তো এই দুই লিঙ্গের মধ্যকার রসায়নগত যোগমন্ত্র। পারস্পরিক যোগসূত্রের ঐক্যের এই চিরায়ত ভাবধারাকে দূরে সরিয়ে রেখে দেখতে না পাওয়া বা চাওয়ার ভাবকে আর যাই হোক স্বাভাবিক বলা যাবে না। সভ্যতার উন্মেষ বিকাশের ধারাবাহিকতায় এটা অনস্বীকার্য যে, নারীর সৌন্দর্য-শিল্পের ধ্বংস-বিনাশের মনোভাব মনোবৃত্তি এককথায় অস্বাভাবিকতা তথা বিকারগ্রস্ততারই পরিচায়ক। আর সব জৈবিক ক্রিয়া-কর্মের মতোই ‘যৌনক্রিয়া’ জীবের সাধারণ একটি ক্রিয়াÑ সন্দেহ নেই। তাবৎ জীবকুলের বংশগতি রক্ষার জন্যও তো এটা অত্যাবশ্যকীয়। জীব জগতের অন্যসব প্রাণী থেকে মানুষ তার মেধা, বুদ্ধিমত্তায়, সৃজনশীলতায়, বোধে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে স্বীকৃত। পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের কাঠামোতে মানুষ তার পরিচয়কে তুলে ধরে সভ্যতার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। মনুষ্যত্ব এবং বিবেক বোধের ধারক মানুষের পক্ষে জীবের স্বাভাবিক প্রবণতার শীলন, পরিশীলন, উন্নয়ন বিকাশ ঘটানো সভ্যতারই অঙ্গ। সুতরাং সহজাত-স্বাভাবিক বিষয়টিকে সহজভাবে দেখে যত ভালভাবে তার মোকাবেলা করা যায় তাতেই মঙ্গল। মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এই বিষয়টিকে নিষিদ্ধ এক বিষয় হিসেবে পাশ কাটিয়ে গেলেই কোন সমাধান নেই, বরং বিপত্তি বা বিস্ফোরণের সম্ভাবনাই বেশি। তারই তো সব ভয়াবহ চিত্র চারপাশে। ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ তা তো আর নয়। অন্ধের মতো দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বিমর্ষ বদনে মুখ ফিরিয়ে রাখলেই তো আর সমাধান আসে না। সমাজ ব্যবস্থায় নারী এবং পুরুষÑ অনিবার্য দুই বিপরীত লিঙ্গেরÑ মানব-মানবীর পারস্পরিক জানা-বোঝার বিষয়টি যদি সাবলীল না হয়ে দূরুহয়ে পড়ে, নর-নারীর মধ্যকার স্বাভাবিক আচার আচরণে বাধার সৃষ্টি হয়, অন্তর্গত প্রবৃত্তি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে বিকৃতির মধ্য দিয়েই আত্মপ্রকাশ করতে চায় তখন। বলতে গেলে শৈশব-কৈশোর থেকেই বিপরীত লিঙ্গের সহজ জানা-বোঝার অন্তরায়ের কারণেই পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব, বৈষম্য, বিভেদ বাড়তে থাকে আমাদের সমাজে। পরিবারে ছেলেমেয়ে দুই-ই সমান এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশÑ এই ধারণাটা শৈশব-কৈশোর থেকেই জন্মাতে হয়। পিতা-মাতা তথা স্বামী-স্ত্রীর সহাবস্থানে যেমন সংসার-পরিবার; তাদের মিলিত ক্রিয়ায় উদ্ভূত সন্তান-সন্ততি লিঙ্গ-বর্ণ ভেদে সমান গুরুত্বপূর্ণ তথা অধিকারেরই অংশ পরিবারে। ছেলে এবং মেয়ে পরস্পরে তারা একে অন্যের সহযোগী, কোনভাবেই কেউ কারও থেকে বড় কিংবা হেয় নয়। এই সহজ সত্যটি তো দিনের আলোর মতোই সত্য। একে সত্য ভাবতে শেখাতে হবে এবং কৈশোরকাল থেকেই শরীরগত, মনোগত, বিষয়গুলো সহজভাবে জানা-বোঝার সুযোগ তৈরি করতে হবে পরিবারে, বিদ্যালয়ে, পাঠাগারে। সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ের প্রতি, নারীর প্রতি তথা স্ত্রী জাতির প্রতি বৈষম্য, অমর্যাদা, অসম্মান থেকেই সংসারে যত বিপত্তির উৎপত্তি। অসম পারিবারিক পরিবেশে লালিত পুত্রসন্তান অতি অনায়াসেই তো বুঝে নেয় সংসারে, পরিবারে বোন-মাতা তথা স্ত্রী জাতীয়রা নিগৃহীত। নিগৃহীত মানুষজন আর যা-ই হোক মনের মধ্যে সম্মান কিংবা ভালবাসার উদ্রেক ঘটাতে পারে না। অথচ দরকার ভালবাসাবোধ এবং মমত্ববোধের উন্মেষ। মেয়েদের ভালবাসতে শেখাতে হয়। বোন যেমন ভালবাসে ভাইকে, ভাইটিকেও তো শেখাতে হয় বোনকে ভালবাসতে। ‘কে যায় ভাটির গাং বাইয়া আমার ভাইরে কইও নাইওর নিত আইয়া...’ কবির মরমী সুরের মতো বলতে গেলে সারাটা জীবনই তো বোন কাটিয়ে দেয় ভাই এবং পিতৃমাতৃ ঘরের কথা মনে করে। সেই বোনটিকে একবার ভালবাসতে শিখলে জগতের ভ্রাতাকুলের ভবিষ্যতে আর নারীর প্রতি ভালবাসাহীনতায় ভুগতে হবে না। প্রকৃতির অনিবার্য দুই লিঙ্গের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ, ভালবাসাপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়ের পক্ষেই সম্ভব নারী-পুরুষের মধ্যে সহজ সম্পর্কবোধে বিকশিত হওয়া। বাংলা, ইংরেজী এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা যে দেশে সমানতালে এগিয়ে চলে, দুর্নীতি তথা অর্থনৈতিক বৈষম্য যেখানে চরম আকার ধারণ করেÑ সেখানে সেই পরিস্থিতিতে আর যা-ই হোক সুস্থ আচরণ আশা করা যায় না। আইন-শাসন, সাজা, ভয়ভীতির মাধ্যমে সাময়িক প্রশমনের এক প্রকার চেষ্টা চালানো যায় হয় তো। তারপরও তো আইনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষজন আমাদের এই সমাজেরই একেকজন পুরুষ! তাই তো এক সত্যের পুনরাবৃত্তি করেই এই লেখার ইতি টানব। মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য, ভালবাসা এবং প্রেমের কোন বিকল্প নেই। প্রেম-ভালবাসায় নর-নারীর সহাবস্থানে যে আনন্দ-সুখের উপলব্ধি ঘটে, দুনিয়ার বুকে তার কোন তুলনা নেই। লেখক : চিকিৎসক
×