ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র শা’বান মাস ও লায়লাতুল বারাআত

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২৯ মে ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ পবিত্র শা’বান মাস ও লায়লাতুল বারাআত

হিজ্্রী সন বিশুদ্ধ চান্দ্র সন। এর অষ্টম মাস হচ্ছে শা’বান। শা’বান শব্দের অর্থ শাখা-প্রশাখা বের হওয়া। এর শব্দমূলগত অর্থ গিরিপথ। প্রাচীন আরবে একে বলা হতো আদিল। হযরত রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম শা’বান মাসে সর্বাধিক নফল সিয়াম (রোজা) পালন করতেন। তিনি বলেছেন : এ মাস রজব ও রমাদানের মধ্যবর্তী। অথচ এ মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন। এই মাসের মধ্যবর্তী রাত অর্থাৎ ১৪ শা’বান দিবাগত রাতকে বলা হয়েছে লায়লাতুল বারাআত তথা নিষ্কৃতি বা মুক্তির রাত। বলা হয়েছে : লায়লাতুল বারাআতে ইবাদত করলে তার অসিলায় বছরের গুনাহ্্ মাফ হয়, জুমু’আর রাতে ইবাদত করলে তার অসিলায় বছরের গুনাহ্্ মাফ হয়, জুমু’আর রাতে ইবাদত করলে তার অসিলায় সপ্তাহের গুনাহ্্ মাফ হয়। লায়লাতুল কদরে ইবাদত করলে তার অসিলায় জীবনের গুনাহ্্ মাফ হয়। মধ্য শা’বানের রাতকে (লায়লাতুন্্ নিসফি মিন্্ শা’বান) হায়াতের রাতও বলা হয়েছে। বর্ণিত আছে যে, দুই ঈদের (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আয্্হা) রাতও মধ্য শা’বানের রাত জেগে ইবাদত করলে অন্তর এমন প্রাণবন্ত হয় যে, সে দিনও অর্থাৎ শেষ বিচারের দিনও তা প্রাণবন্ত থাকবে। মধ্য শা’বানের রাতে সারারাত জেগে থেকে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে যেমন প্রচুর সওয়াব লাভের কথা বলা হয়েছে তেমনি দিবসে সওম পালনে অশেষ সওয়াব রয়েছে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, ৬২৪ খৃস্টাব্দের মধ্য শা’বানের দিবসে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধান আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু নাযিল করেন, যার একটি হচ্ছে রমাদান মাসকে সিয়াম পালনের মাস হিসাবে নির্ধারণ করা আর অন্যটি হচ্ছে জেরুজালেমের মসজিদুল আক্্সার দিক থেকে কিবলা পরিবর্তন করে মক্কা মুর্ক্রামার মসজিদুল হারামের দিকে কিবলা করা। সিয়ামের বিধান দিয়ে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের প্রতি সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতিÑ যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েকদিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। এটা যাদেরকে অতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদ্্য়াÑ একজন মিস্কিনকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালো কাজ করে তাহলে তা তার জন্য অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণপ্রসূ যদি তোমরা জানতে। রমাদান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী আল কুরআন। সুতরাং তোমরা যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা তাতে সিয়াম পালন করবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫)। সিয়ামের হুকুম নাযিল হবার সেই শা’বান মাসের শেষ দিনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে এক দীর্ঘ খুতবায় বলেছিলেন : তোমাদের ওপর এমন একটি মহান মাস ছায়া বিস্তার করতে যাচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী-লায়লাতুল কদর। আল্লাহ্্ তা’আলা এই মাসে সিয়াম পালন করাকে ফরয করে দিয়েছেন। এই মাসের রাতে তারাবীহ্্র সালাত আদায় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। যে ব্যক্তি এ মাসের একটি নফল আদায় করবে সে অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করলে যে সওয়াব পেতো সেই সওয়াব পাবে, যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরয আদায় করবে, সে অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায়ের সমতুল্য সওয়াব প্রাপ্ত হবে। এটা সবরের মাস আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। এই মাস হচ্ছে সহমর্মিতা ও সমবেদনার মাস। শা’বান মাসের সেই শেষদিনের অবসানকালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম রমাদনের মাহাত্ম্য সম্পর্কে প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণের শেষ পর্যায়ে বললেন : এ (রমাদান) মাসের প্রথম ভাগ হচ্ছে রহমতের, মধ্যভাগ হচ্ছে মাগফিরাতের এবং শেষ ভাগ হচ্ছে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাবার। ৬২৪ খৃস্টাব্দের মধ্যে শা’বানে রমাদান মাসে সিয়াম পালনের জন্য বিদান যেমন নাযিল হয় তেমনি কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশও নাযিল হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনা মনওয়ারা থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে একটি মসজিদে কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে যুহরের সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট ওহী প্রেরণ করে ইরশাদ করলেন : আসমানের দিকে আপনার বার বার তাকানোটাকে আমি অবশ্যই লক্ষ্য করি। সুতরাং আপনাকে অবশ্যই এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দিচ্ছি যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব আপনি মসজিদুর হারামের দিকে মুখ ফিরান। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৪৪)। এই নির্দেশ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সালাতরত অবস্থাতেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুকাররমার মসজিদুর হারামের দিকে মুখ ফিরালেন, তাঁর পিছনে তাঁর ইমামতে সালাত আদায়রত সাহাবীগণও তাঁকে অনুসরণ করলেন। যে মসজিদে এই কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছিলো সে মসজিদ এখনও মদীনা মনওয়ারার উপকণ্ঠে বর্তমান রয়েছেÑ যার নাম দুই কিবলার মসজিদ-মসজিদে কিবলাতায়ন। বর্তমান লেখক মসজিদে কিবলাতায়নে বেশ কয়েকবার গিয়েছেন এবং নফল সালাত আদায় করেছেন। রমাদান মাসের সিয়াম পালনের জন্য নিজেকে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুত করার মাস শা’বান। এই প্রস্তুতির চূড়ান্ত প্রস্ফুরিত হয় লায়লাতুল বারাআতে। এই রাতকে শাফা’আতের রাতও বলা হয়েছে। আবার এটাকে মাগফিরাতের রাতও বলা হয়েছে। মধ্য শা’বানের খাস রজনী লায়লাতুল বারাআত যেমন মুক্তির রাত তেমনি এটাকে ভাগ্য রজনীও বলা হয়ে থাকে। এক বছরের ভাগ্যের নানাদিক লিপিবদ্ধ হয় এ রাতে। যে কারণে মধ্য শা’বানের রাতটিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা উচিত। আমাদের দেশে বিশেষ করে যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর অঞ্চলে শা’বান মাসকে রুটির চাঁদ বলে। এর কারণ লায়লাতুল বারাআতে বিশেষ করে চালের গুঁড়োর রুটি এবং হালুয়া বানিয়ে গরীবদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এটা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এবং সামাজিক সৌহার্দ্য ও সংহতি বন্ধনে অনন্য মাত্রা সংযোজন করেছে। মধ্য শা’বানের রাতে হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম খাসভাবে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে কবরসমূহ যিয়ারত করতেন এবং গৃহে ফিরে দীর্ঘক্ষণ সিজদারত অবস্থায় দু’আ করতেন। সেই সব দু’আর একটি হচ্ছে : আ’উযু বিরিদাকা মিন শাখতিকা ওয়া বি’আফতিকা মিনউকূবাতিকা ওয়া বিকা মিনকা লা উহসী ছানাআন আলায়কা আনতা কামা আছনায়তা নাফসিকা আকূরু কামা কালা আখী দাউদু আ’ফারু ওয়াজহী ফীততুরাবি লি সাইয়েদী ওয়া হাক্কা লিওয়াজহি সাইয়েদী আন ইয়াগফির। মধ্য শা’বানের এই রাত হচ্ছে ঈদুল মালায়েকা-ফেরেশতাদের ঈদ। শা’বান মাস রমাদানে প্রবেশের মহাসড়ক। প্রাচীন আরবে যখন বর্ষ গণনা করা হতো সৌর হিসেবে তখন রমাদানা ছিল গ্রীষ্মের প্রথম মাস আর সেই মাসের পূর্ববর্তী মাস শা’বান। শা’বান মাসের বিশেষ করে মধ্য শা’বানের রাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে বেশ কয়েকখানি হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। বুযুরগানে দীন, সুফীয়ায়ে কিরাম মধ্য শা’বানের রাতে জেগে থেকে ইবাদত বন্দেগী, যিকর-আয্্কার, মুরাকাবা-মুশাহাদা, তিলাওয়াতে কুরআন, নফল নামায, দু’আ-দরুদ, মিলাদ মহফিল, দান-খয়রাত, কবর যিয়ারত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে লায়লাতুল বারাআত বা শবে-বরাত পালন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। এমনকি ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হির মুকাশাফাতুল কুলুব গ্রন্থে শবে-বরাতের ওপর দীর্ঘ লেখা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন : মধ্য শা’বানের রাতকে বলা হয় কিসমত বা তকদীরের রাত। অথচ ইদানীংকালে হাতেগোনা কিছু মওলানা উপাধিধারী ব্যক্তি শবে-বরাতের বিরুদ্ধে বলার চেষ্টা চালিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। তারা যে মতলববাজ তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রকৃত পীর-মাশায়েখ, আলিম-উলামা মধ্য শা’বানের এই রাত অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পালন করেন এবং অন্যকে পালন করতে বলেন। তবে এটা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে এ রাত ইবাদত করবার রাত। এ রাত পটকা ফোটানো আতশবাজি পোড়ানো বা হৈ-হুল্লোড় করে কাটানোর রাত নয়, এসব করা গুনাহ্্র কাজ। যুগ শ্রেষ্ঠ সূফী হযরত মওলানা শাহ্্ সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ.) বলেছেন : শবে-বরাত শবে কদরের আগাম বার্তাবাহক। এই রাতে বেশী বেশী করে নফল ইবাদত করা উচিত। লেখক : পীর সাহেব দ্বাড়িয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×