ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানব পাচার প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৯ মে ২০১৫

মানব পাচার প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ

মে মাসের প্রথম দিকে থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের জঙ্গলে বিভিন্ন গণকবর আবিষ্কার এবং এসব গণকবর থেকে আবিষ্কৃত পাচারকৃতদের লাশ উদ্ধারের খবর প্রকাশের পর থেকে সমুদ্রপথে মানব পাচার প্রায় প্রতিনিয়তই পত্রিকাগুলোর বিশেষ শিরোনাম হয়ে আসছে। মানব পাচারের ক্রমাগত উদ্বেগজনক বৃদ্ধির হার সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথে শত শত মানুষকে কার্গোজাহাজে প্রথমে থাইল্যান্ড ও পরে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাচার করা হয়েছে। মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনিয়মিত সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আশায় ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে যাত্রা করছে হাজারো মানুষ। সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই মানব পাচার বেড়েছে ৬১ শতাংশ। প্রধানত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাচার হওয়া এসব মানুষের মধ্যে বাংলাদেশীদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাও রয়েছে। গত বছর জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে গেছেন ৫৩ হাজার লোক। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পুলিশ সূত্রে এটা পরিষ্কার যে, এদের অধিকাংশই বাংলাদেশে আশ্রিত হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। বাংলাদেশে মানব পাচার নতুন কিছু নয়। এক সময় মানব পাচার বলতে অনেকটা নারী ও শিশু পাচারকেই বোঝাত। নব্বই দশকে ব্যাপক আকারে নারী ও শিশু পাচার অপরাধ শুরু হয়। ২০০০ সালে পাসকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৫ ও ৬ ধারায় নারী ও শিশু পাচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অন্তর্ভুক্ত করে কঠোর আইন করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন মূলত দীর্ঘদিন থেকে দেশের কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, যশোর, লালমনিরহাট, ময়মনসিংহ, সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমন্তবর্তী এলাকাসমূহ দিয়ে প্রচুর নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা সংঘটিত হতো। প্রায়ই গ্রেফতারকৃত পাচারকারী ও পাচারকৃতদের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হত। কিন্তু পরে কাজের নামে ও যৌন শোষণের জন্য নারী ও শিশু পাচারের পাশাপাশি অনেক পুরুষও সীমান্তপথে বিদেশে পাচার হতে শুরু করে। এরপর একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মানব পাচার ঘটনা বাড়তে থাকে। পরে সীমান্ত এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নেয়ার কারণে সমুদ্রপথে নারী-শিশু ও পুরুষসহ মানব পাচারের ঘটনা বহুলহারে বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের পাচার আন্তর্জাতিক আইন, আমাদের সংবিধান ও দেশীয় আইনে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। নারী ও শিশু পাচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও দেশের বিভিন্ন প্রচলিত আইনে সুনির্দিষ্ট ধারা ও শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে যে কোন ব্যক্তির (পুরুষ, মহিলা ও শিশু সকলেই অন্তর্ভুক্ত) পাচার সংজ্ঞায়িত করে সুনির্দিষ্ট কোন আইন ও কঠোর শাস্তির বিধান ২০১২ সালের আগে ছিল না। যদিও ১৮৬০ সালের দ-বিধিতে মানব পাচারের বিভিন্ন প্রেক্ষিত যেমন কোন ব্যক্তির কিডন্যাপিং, অপহরণ, দাসত্ব ও জবরদস্তিমূলক শ্রম এবং পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা ক্রয় ও বিক্রয় বিষয়ে শাস্তির ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ও সরাসরি ব্যক্তির পাচারের বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৪-এ মানব পাচারের মতো বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে বলা হয়, ‘সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ এবং এই বিধান কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৫৯-৩৭৪ ধারাসমূহে কিডন্যাপিং, অপহরণ, দাসত্ব এবং জবরদস্তিমূলক শ্রমের ব্যাপারে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এই অপরাধগুলোর জন্য শাস্তি অর্থদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও অপরাধের গভীরতা অনুযায়ী শাস্তির ক্ষেত্র পরিলক্ষিত হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দণ্ডবিধি অনুযায়ী জবরদস্তিমূলক শ্রমের ব্যাপারে শাস্তির মাত্রা যে কোন মেয়াদের সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। যেখানে আমাদের সংবিধানে জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ ও জবরদস্তিমূলক শ্রম মানব পাচারের অন্যতম একটি উপাদান বা প্রেক্ষিত সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি ১ বছর বা অর্থদণ্ড খুবই হাস্যকর। এর বাইরেও অনৈতিক পাচার প্রতিরোধ এ্যাক্ট, ১৯৩৩ (ঝঁঢ়ঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ওসসড়ৎধষ ঞৎধভভরপশ অপঃ, ১৯৩৩) নামে একটি আইন রয়েছে, যেখানে বেশ্যালয় (নৎড়ঃযবষ) এবং নারী ও শিশু পাচার দমনের ব্যাপারে শাস্তি প্রদানের কথা বলা আছে। তবে এ আইনে শাস্তি অত্যন্ত লঘু প্রকৃতির এবং এখানেও শুধু নারী ও শিশু পাচারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতদিন ধরে বাংলাদেশে মানব পাচার বলতে নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এই আইনটিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী আইন হিসেবে বিবেচনা করা হতোÑ যেখানে নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মূলত প্রথমবারের মতো এই আইনের মাধ্যমে সরাসরি নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করে দণ্ডবিধির চেয়েও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন বিশেষ করে টঘ চৎড়ঃড়পড়ষ ঃড় চৎবাবহঃ, ঝঁঢ়ঢ়ৎবংং ধহফ চঁহরংয ঞৎধভভরপশরহম রহ চবৎংড়হং, ২০০০ অনুযায়ী পাচারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছেÑ পাচার বলতে যে কোন ধরনের হুমকি বা বল প্রয়োগ, প্রতারণা, অসৎ উপায় বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে শোষণের জন্য কোন ব্যক্তির নিয়োগ ও হস্তান্তরকে বোঝায়। শোষণকে বৃহত্তর অর্থে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে পতিতাবৃত্তি, যৌন শোষণ, জবরদস্তিমূলক শ্রম বা সরবরাহ, দাসত্ব এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গ অপসারণ ইত্যাদি শোষণের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে অন্য রাষ্ট্রগুলোর ন্যায় বাংলাদেশেরও অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে পাচারের শাস্তি প্রদান করা এবং পাচারের শিকারকৃত ব্যক্তিদের সুরক্ষা প্রদান করা। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে কোন ব্যক্তি (পুরুষ, মহিলা ও শিশু সকলেই অন্তর্ভুক্ত) পাচারের বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করে শাস্তির ব্যবস্থা এবং পাচারের শিকারকৃত ব্যক্তিদের সুরক্ষা প্রদান করার জন্য নতুন আইন পাস করার প্রয়োজন ছিল সময়ের দাবি। ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন নামে একটি নতুন আইন পাস করে। এই আইনে পাচারকারীদের শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি পাচারের শিকার ব্যক্তিবর্গের সুরক্ষা ও অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। এই আইনের ফলে ২০০০ সালে পাসকৃত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৫ ও ৬ ধারা অকার্যকর করা হয়েছে। এই আইনের ধারা ৩-এর উপধারা (১) অনুযায়ী ‘মানব পাচার’ অর্থ কোন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ করে বা প্রতারণা করে বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (াঁষহবৎধনরষরঃু) কাজে লাগিয়ে বা অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (শরহফ) লেনদেনপূর্বক উক্ত ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোন শোষণ বা নিপীড়নের (বীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ) উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া (যধৎনড়ঁৎ)। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আইন এবং বাংলাদেশ সরকারের এটি একটি সাহসী উদ্যোগ। সকলে মনে করেছিল এই আইনটি পাসের পর মানব পাচারের ঘটনা কমবে। কিন্তু আইনটি সম্পর্কে জনমনে এখনও যথাযথ সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বেকারত্ব, দরিদ্রতা, ভূমিহীনতা, অশিক্ষা, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রলোভনের শিকার, গ্লোবালাইজেশন ইত্যাদির কারণে বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখায় সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্রমশ তা মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যার বহির্প্রকাশ ও করুণ পরিণতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনিয়মিত সমুদ্রপথে মানব পাচারের ঘটনা এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গণকবর থেকে লাশ উদ্ধার বিশ্বজুড়ে মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করেছে এবং এমন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে নিন্দার ঝড় বইছে। মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সাহায্য ও মানব পাচার প্রতিরোধে গত ২০ মে ২০১৫ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডে একটি বৈঠক হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মানব পাচার প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধান খুঁজছে। বাংলাদেশ সরকারও মানব পাচার প্রতিরোধে সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে সমুদ্রপথ ও সীমান্তপথে মানব পাচার প্রতিরোধে কয়েকটি সুপারিশ রাখছি, যা শুধু মানব পাচার প্রতিরোধই করবে না, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি আনায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সুপারিশগুলোর মধ্যে প্রথমত, ২০১২ সালে প্রণীত মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। এই আইনটি মানব পাচার প্রতিরোধে অত্যন্ত আধুনিক ও শক্তিশালী। সবচেয়ে বেশি যে দিকটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রত্যেক জেলায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও মানব পাচারকারীদের শাস্তি প্রদানের নিমিত্তে পৃথক মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। এটি গঠিত না হওয়ায় এ সংক্রান্ত মামলাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও প্রত্যেক জেলায় মানব পাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়া পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এই বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে আশার কথা, ইতোমধ্যে আমাদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দেশের ৭ বিভাগে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া এই আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা নামে যে প্রতিষ্ঠান গঠন করার কথা বলা হয়েছে তাও বাস্তবায়িত করতে হবে। এ আইনটি পাস হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোন বিধিও পাস করা হয়নি, যা খুবই জরুরী। এই আইনের ৫ম অধ্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিবর্গ এবং সাক্ষীদিগকে সহায়তা এবং তাদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসন ইত্যাদি সম্পর্কে বলা হয়েছে। মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিবর্গকে বা ভিকটিমদের চিহ্নিতকরণ এবং উদ্ধার সম্পর্কে আইনের ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘সরকার মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, উদ্ধার, প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনকল্পে বিধি দ্বারা কর্মপ্রণালী তৈরি করবে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাসমূহের সহিত অংশীদারিত্বে কাজ করবে।’ ভিকটিম বা মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিবর্গের প্রত্যাবাসন (ৎবঢ়ধঃৎরধঃরড়হ) এবং প্রত্যাবর্তন (ৎবঃঁৎহ) সম্পর্কে আইনের ধারা ৩৩(১) বলা হয়েছে- ‘কোন বাংলাদেশী নাগরিক অন্য কোন দেশে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হলে, সরকার সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসের এবং প্রয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় উক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ফেরত আনবার প্রক্রিয়ার সূচনা করবে।’ ধারা ৩২ ও ৩৩-এর বাস্তবায়ন ঘটাতে সরকারকে ব্যাপক ও বাস্তবমুখী শক্তিশালী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানব পাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করা। ভাল চাকরির নামে মেয়ে, শিশু ও পুরুষকে কিভাবে বিদেশে জবরদস্তিমূলক শ্রমসহ যৌন শোষণ ও পতিতাবৃত্তির মতো নিষ্ঠুর কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে তা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। এই কাজটি সরকারের জন্য এককভাবে কঠিন কাজ। বাংলাদেশে কর্মরত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহের সঙ্গে সরকার ঘবঃড়িৎশরহম বা যোগাযোগের মাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে পারে। এ বিষয়ে সরকারী উদ্যোগে বিজ্ঞাপন তৈরি করে বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে মানব পাচারের কুফল সম্পর্কে জনগণকে ব্যাপকভাবে সচেতন করা যায়। তৃতীয়ত, মানব পাচার প্রতিরোধে আঞ্চলিক সরকারগুলোর মধ্যে সমন্বিত নেতৃত্বের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ান ও সার্ককে আরও গতিশীল করতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। চতুর্থত, সহিংসতার শিকার হয়ে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী কিংবা হতদরিদ্র অভিবাসীদের অধিকার ও নিরাপত্তা অবশ্যই আঞ্চলিক সরকারগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি বেআইনী অভিবাসনের চেষ্টা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নিতে হবে। ষষ্ঠত, মানব পাচার ঠেকানোর মতো আধুনিক জলযান পুলিশের কাছে দিতে হবে এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদস্যদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। সপ্তমত, মানব পাচার সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির জন্য পুলিশ ও জনগণ সমন্বয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ‘মানব পাচারবিরোধী কমিটি’ গঠন করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সীমান্ত এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। মানব পাচারের মতো নিষ্ঠুর অপরাধ দমন করা যে কোন দেশে এককভাবে সরকারের জন্য খুবই কঠিন কাজ, বাংলাদেশের মতো দেশে তা আরও দুরূহ। আমাদের দেশে এ রকম একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ দমনে সরকারকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতে হবে সকল রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ও সর্বোপরি দেশের সাধারণ জনগণকে। লেখক : শিক্ষাবিদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
×