ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের পচাগলা লাশ, হাড়গোড়

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৮ মে ২০১৫

মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের পচাগলা লাশ, হাড়গোড়

ফজলুল বারী, সিডনি থেকে ॥ মালয়েশিয়ায় এখন শুধু মানবপাচারের শিকার হতভাগ্য বাংলাদেশী-রোহিঙ্গাদের পচা লাশ-গণকবর না, পাওয়া যাচ্ছে অনেক মানবিক কাহিনী। থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের ওয়াং কেলিয়ান গ্রামটি হঠাৎ করে এখন চলে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার স্পটলাইটে! কারণ ওই গ্রামের পাশের গ্রামে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাওয়া গেছে স্মরণকালের বেদনাদায়ক মানবপাচারের শিকার হতভাগ্যদের কমপক্ষে ১৪০ গণকবর! বেশকিছু পচাগলা লাশ। গার্ডিয়ানের একজন সাংবাদিক ওই এলাকা ঘুরে এসে তার রিপোর্টে তুলে এনেছেন বেশকিছু করুণ কাহিনী। ওই রিপোর্টে যে তথ্যটি উঠে এসেছে তাহলো- মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ ঘটনা নিয়ে বিস্ময় দেখালেও ওখানকার গ্রামবাসীর বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পাচারের লোকজন দেখার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। অনেকে দুই বছর আগ থেকেই এমন দেখে আসছেন। মাঝে মধ্যেই তারা এমন অচেনা নতুন মুখ দেখতেন। তবে জানতেন বা মনে করতেন এরা থাইল্যান্ড থেকে এসেছে। এক গ্রামবাসী বলেন, দুই বছর আগে তিনি একসঙ্গে এমন দশজনকে দেখেছেন। সেটাই এলাকায় তার দেখা সর্বোচ্চসংখ্যক বিদেশী। কিন্তু এবার যে গ্রামের জঙ্গলের ভেতর এত লোকজনকে রাখা হয়েছিল, তা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। আসলে সীমান্ত এলাকা বলে জঙ্গলের অত ভেতরের দিকে তাদের সে রকম যাতায়াতও ছিল না। এখন সেখানে একের পর এক গণকবর-পচাগলা লাশ পাওয়া যাচ্ছে শুনে তারা যারপরনাই বিস্মিত-মর্মাহত। গ্রামটির নিকট দূরত্বের ছোট শহরের এক দোকানি লায়জা ইব্রাহিম গার্ডিয়ানের সাংবাদিককে বলেছেন, তাদের গ্রামের রাস্তায় মাঝে মধ্যে তারা কিছু নতুন মানুষ দেখতেন। তারা ছিল খুব দুর্বল, আঘাতপ্রাপ্ত। মাঝে মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা মহিলা তাদের বাড়িতে-মসজিদে এসে খাবার, পানি এসব ভিক্ষা চাইত। আরেক মহিলা বলেন, তিনি একদিন এমন আগন্তুক এক বাংলাদেশীকেও দেখেছেন। দোকানি লায়জা ইব্রাহিম বলেন, একদিন তেমন একজন আমার দোকানে আসে। তার আঘাতপ্রাপ্ত হাত-পা কাপড়ে লুকোনো ছিল। সে জানতে চাইল, এটা কী মালয়েশিয়া? এরপর সীমান্ত দেখিয়ে বলে, ওদিকটা? থাইল্যান্ড শুনে সে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে যায়। মহিউদ্দিন আহমদ নামের একজন বলেন, আসল কাহিনী শোনার পর আমরা খুব ব্যথিত হয়েছি। কারণ বিপদগ্রস্ত আমাদের কাছে যারা সাহায্য চাইতে এসেছিল আমরা তাদের কিছু খাবার, পুরনো কাপড় ছাড়া বিশেষ কিছু দেইনি। চলতি (মে) মাসের শুরুর দিকে থাইল্যান্ডের সীমান্ত লাগোয়া জঙ্গলে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু, বেশকিছু গণকবর, কিছু লোকজন উদ্ধারের পর পুরো বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আসে। জঙ্গলে লুকোনো লোকজনকে সাগরে ভাসিয়ে দিলে কয়েক হাজার ভাসমান মানুষের নৌকাগুলো যার যার দেশের তীরে ভিড়তে দিতে অস্বীকৃতি জানায় থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া। সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ডুবন্ত এক নৌকার যাত্রীদের উদ্ধার করে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা। এরপর জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক জনমত সরব হলে দেশ তিনটির বর্বর ভূমিকা পাল্টায়। শুরুর দিকে মালয়েশিয়া এসব পাচারের সঙ্গে তার দেশ জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করলেও ওয়াং কেলিয়ান গ্রামের গণকবর সব উদ্ধারের সঙ্গে সেই দাবি থেকে তারা সরে এসেছে। মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান বলেছেন, কোন কোন কবরে একাধিক লাশ মাটিচাপা দেয়া ছিল। গলিত যত লাশ তারা উদ্ধার করেছেন তা শ’ ছাড়িয়ে গেছে। গলিত একটি লাশের সঙ্গে পাওয়া একটি কলম পুলিশের এক সদস্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিককে দেখান। জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া গেছে পাচারকৃতদের রাখার পরিত্যক্ত ক্যাম্পসমূহ। গণকবরগুলো এসব ক্যাম্পের কাছাকাছিই ছিল। গণকবরের খবর জানার পর গ্রামবাসীর মনে পড়েছে তারা যাদের জীবিত দেখেছেন তাদের সবাই ছিল মারধরে আহত। মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান বলেছেন, এসব পাচারের সঙ্গে মালয়েশিয়ার কেউ জড়িত পাওয়া গেলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে। কিন্তু জাতিসংঘের এন্টি ট্রাফিকিং গ্রুপের এক সাবেক কর্মকর্তা গার্ডিয়ানকে বলেছেন মালয়েশিয়া এসবের কিছুই জানত না বলে যে সুবোধ ভাব করছে, আসল চিত্রটি তা নয়। এলাকাটি ২০০৯ সালেই মার্কিন এন্টি ট্রাফিকিং রিপোর্টে বিশেষ একটি খারাপ স্পট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। দুই বছর আগে তিনি এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা এসবের কোন ফলোআপ করেনি। এর আগে বিবিসির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল থাইল্যান্ডের সরকারী-বেসরকারী নানা লোকজন জড়িত ছিল এসব পাচারে। গার্ডিয়ানের রিপোর্টে এবার মালয়েশিয়ার দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে।
×