ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কর্মকর্তা ও পিয়নের কাছে জিম্মি আবেদনকারীরা

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস ॥ দুর্নীতিতে ডুবেছে

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৮ মে ২০১৫

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস ॥ দুর্নীতিতে ডুবেছে

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অনিয়ম আর দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে নগরীর মনসুরাবাদে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস। উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন-আনসারের কাছে জিম্মি আবেদনকারীরা। অফিসের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পাসপোর্ট প্রার্থীরা। আর এই দুর্নীতির নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্যরা। এই পাসপোর্ট অফিসে বুধবার অফিস সময়জুড়ে অবস্থান করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। জানা গেছে, জরুরী ও সাধারণ এই দুই ক্যাটাগরিতে সাধারণত গ্রাহকরা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে থাকেন। কিন্তু বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে এই ক্যাটাগরির কোন বালাই নেই। তাদের কাছে মুখ্য পাসপোর্ট আবেদনকারীর ক্যাটাগরি ‘চ্যানেল’ না ‘পাবলিক’। অফিসের আনসার, কর্মচারী, পুলিশ তথা দালালের মাধ্যমে যারা আবেদন করেন তাদের ক্যাটাগরি ‘চ্যানেল’। আর দালাল ছাড়া নিজ উদ্যোগে জমা দেয়া আবেদনের নাম ‘পাবলিক’। পাসপোর্ট অফিসে এই ‘পাবলিক’ আবেদন মূল্যহীন। ‘পাবলিক’ আবেদন মানেই ভোগান্তি। লাইনে দাঁড়ানো, ছবি তোলা, পুলিশ প্রতিবেদন পদে পদে ‘পাবলিক’ আবেদনকারীদের ভোগান্তির শেষ নেই। জরুরি ফি জমা দিয়ে পাবলিক আবেদনে পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় দুই মাস। অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি। আর চ্যানেল আবেদনকারীরা সরবরাহ পেয়ে যান নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই। কয়েকজন আবেদনকারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সাধারণ পাসপোর্টের জন্য তিন হাজার ও জরুরীর জন্য ছয় হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। নিয়মানুযায়ী সাধারণ পাসপোর্ট এক মাস ও জরুরী দুই সপ্তাহের মধ্যে সরবরাহের কথা। কিন্তু নিয়মের এই বালাই নেই মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে। আবেদনের সঙ্গে ‘ঘুষের’ টাকা পাওয়া গেছে কি-না সেটাই মুখ্য বিষয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি অভিনব চুক্তির মাধ্যমে ভদ্রবেশী কিছু লোক দালাল হিসেবে কাজ করছেন। এই দালালরা প্রথমে গ্রাহকদের দিয়ে অফিস থেকে ফরম তুলে নেয়। পরে ফরম পূরণ থেকে শুরু করে ব্যাংকে টাকা জমা ও নির্ধারিত ডেস্কে ফরম জমা দেয়ার দায়িত্বটি তারা পালন করে। বিনিময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে অতিরিক্ত গ্রহণ করছেন ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। থেকে ১৫শ’ টাকা তুলে দিচ্ছেন কর্মকর্তাদের হাতে। পুলিশ প্রতিবেদনের জন্যে দিচ্ছেন ৫শ’ টাকা। বাকি টাকা দালালরা নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ যখন নিজেই দালাল ॥ বুধবার দুপুরের দিকে মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতেই গেটে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক পুলিশ সদস্য। ভেতরে প্রবেশের পর দেখা মিলল আরেক পুলিশ সদস্যের। পাসপোর্ট কিভাবে করা যায় জানতে চাইলে ভেতরে থাকা ওই পুলিশ সদস্য বলেন ভেরিফিকেশন কয় জায়গায় হবে? দুই জায়গায় বলতেই তিনি বলেন তাহলে সাড়ে ৭ হাজার টাকা লাগবে। একটু কম নেয়া যায় না বললে ওই পুলিশ সদস্য দুই জায়গায় ভেরিফিকেশন হবে তাই কম নেয়া যাবে না বলে জানান। এক নম্বর কাউন্টারে মিলে দালালদের ভিজিটিং কার্ড ॥ সরেজমিনে গিয়ে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে ঢুকতেই গেটে দায়িত্বরত আনসার সদস্য বলেন এক নম্বর কাউন্টারে যেতে। কাউন্টারে গিয়ে একটি ফরম নিয়ে কিভাবে ফরম জমা দিব জানতে চাইলে কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মহসিন নামের কর্মকর্তা তার টেবিলের ওপর রাখা ভিজিটিং কার্ড থেকে একটি কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, রাস্তার ওপারে তাদের অফিস সেখানে গেলে আপনাকে ওরা সব কাজ করে দিবে আপনার কিছু করতে হবে না। শুধু আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাদের কাছে দিলে বাকি কাজ ওরা নিজেরা করে ফেলবে। পুলিশ ভেরিফিকেশনও ওরা দেখবে। মহসিনের দেয়া মেসার্স হাজারী এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের নামে করা এই ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে ‘এখানে অনলাইনের মাধ্যমে ইন্ডিয়ান ভিসার আবেদন করা হয়, ডলার এনডোর্সমেন্ট করা হয় এবং পাসপোর্ট ফরম পূরণ করা হয়’। দালাল ছাড়া এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যায় না ফরম ॥ মোহাম্মদ শাহ জাহান নামে ভুক্তভোগী এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘গত কয়েক মাস আগে আমি পাসপোর্ট করতে মনসুরাবাদ অফিসে যায়। ফরম পূরণ করে জমাও দেই। এরপর একমাস পার হওয়ার পর আনতে গেলে সেখানে দায়িত্বরত উপ-পরিচালকের কক্ষে গিয়ে জানতে পারি এখনও আমার ফরম ওখানে পৌঁছায়নি। দালাল না ধরে নিজে নিজে কাজ করায় ওখানে ফরম পাঠানো হয়নি। শুধু আমি খবর নিয়ে দেখেছি নিজে আবেদন করা কারও ফরম টাকা ছাড়া এক ডেস্ক থেকে অন্য ডেস্ককে যায় না। হাজারী এন্টারপ্রাইজই সব ॥ কেউ পাসপোর্ট করবেন তাকে মনসুরাবাদের এই পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে না। হাজারী এন্টারপ্রাইজ নামে পাসপোর্ট অফিসের সামনে থাকা প্রতিষ্ঠানে গেলেই চলবে। সেখানে টাকা দিলে তারা সব কাজ করে আপনার হাতে পাসপোর্ট তুলে দেবে। এক্ষেত্রে ৩ হাজার ৪৫০ টাকার পাসপোর্ট খরচের জায়গায় তারা নেবে ৭ হাজার টাকা, ৬ হাজার ৯শ’ টাকার পাসপোর্টে নেবে সাড়ে ১১ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ময়নাল হোসেন হাজারী বলেন, ‘সাড়ে ৩ হাজার টাকার পাসপোর্টে আমাদের দিতে হবে ৭ হাজার টাকা আর ৬ হাজার ৯শ’ টাকার পাসপোর্টে দিতে হবে ১১ হাজার টাকা। টাকা আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিলে পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ যাবতীয় কাজ আমরা করে দেব।’ পাসপোর্ট অফিসকে ঘিরে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের অফিসে কোন দালাল নেই। পুলিশ সদস্যরা গেটে কারও কাছে কাগজ-পত্র না থাকলে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। তাই দালালরা গেট দিয়ে ঢুকতেই পারে না।’ এর বেশি কিছু তিনি মোবাইলে বলতে রাজি হননি।
×