ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বদেশ রায়

মুহিতের ‘হাসিনা মডেল’

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২৮ মে ২০১৫

মুহিতের ‘হাসিনা মডেল’

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষিত লোকের একজন, তা সর্বজন স্বীকৃত। আমাদের মিডিয়ার কিছু অর্ধশিক্ষিত লোকজন ও কিছু অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে নানান অপপ্রচার করেছেন তাঁর কাজের শুরুতে। আবুল মাল আবদুল মুহিত এক কথায় উত্তর দিয়েছেন- ‘অল আর রাবিশ’। অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী বলেই তিনি এত সহজে এদের উত্তর দিতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের কথাকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, সহজ কথা তিনি সহজেই প্রকাশ করেছেন। ২২ মে সিলেটের নিজ বাসভবনে সাংবাদিককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আবুল মাল আবদুল মুহিত সত্যি অর্থে একটি বোমা ফাটিয়েছেন। যে বোমাটি আজ না হোক খুব শীঘ্রই দৃষ্টি কাড়বে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি শুধু নয় বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নতি কোন মাহাথির মডেলে নয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন হাসিনা মডেলে। বাংলাদেশে একশ্রেণীর অর্ধশিক্ষিত রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ আছেন যারা কথায় কথায় বলেন, বাংলাদেশ মালয়েশিয়া হবে, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের অপগ- তারেক রহমান তো একবার বলেই দিলেন বাংলাদেশকে তিনি সিঙ্গাপুর বানাবেন। এ সব তথাকথিত রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের কথা শুনে আমাদের মতো সাধারণ সাংবাদিকদের মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা। কারণ সিঙ্গাপুর একটি পোর্ট সিটি- স্টেট, তার লোকসংখ্যা, তার ভৌগোলিক অবস্থান সবাই জানেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়া নানান খনিজ ও কৃষিসম্পদে সমৃদ্ধ একটি বিশাল দেশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের আয়তন, সম্পদ স্বল্পতা, জনঘনত্ব কোনকিছুই তো সিঙ্গাপুরের বা মালয়েশিয়ার সঙ্গে মেলানো যায় না। তাই স্বাভাবিকই প্রথম প্রথম যখন এই মাহাথির মডেল, লী কুয়ান মডেল অর্থাৎ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এগুলো শুনতাম তখন ঠিক হিসাব মেলাতে কষ্ট হতো। হিসাব মিলত না, কেন এত বড় বড় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এরা এ কথা বলেন। হিসাব মিলে গেল যেদিন তারেক রহমান এ কথা বললেন। পরিষ্কার হয়ে গেল, যারা এ কথা বলেন তারাও তারেক রহমানের মতো জিনিয়াস। আর জিনিয়াসদের ব্রেন কখন কী কাজ করে বসে, কেউ বলতে পারে না। যেমন বিউটিফুল মাইন্ডখ্যাত ম্যাথমেটিশায়ান ন্যাশ অর্থনীতিতে নোবেল পান, আমাদের তারেক রহমানও ইতিহাস নতুন করে রচনা করে ফেলেন, যা গল্পের চেয়েও ভয়াবহ। জিনিয়াস বলে কথা! তাই এসব রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদদের কথায় মাথা ঘুরে গেলেও স্টিমিটিল ড্রাগ খেয়ে ভার্টিগো থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া উপায় নেই। শেখ হাসিনার গত পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে আসছিল, বাংলাদেশ তার নিজস্ব কক্ষপথ তৈরি করেছে। যে কক্ষপথের কিছু কিছু পথরেখা আমাদের মতো সাধারণের কাছে স্পষ্ট হলেও ঠিক বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না যে, কক্ষপথটি পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এমনই সময়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২২ মে বললেন, মাহাথির নয়, ‘হাসিনা মডেল’। অর্থমন্ত্রীর এ কথা পোর্টালে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কাছ থেকে সময় নেই। উদ্দেশ্য একটাই এবারের বাজেট ও ‘হাসিনা মডেল’ এর কক্ষপথ বোঝা। আমাদের অর্থমন্ত্রীর প্রজ্ঞার পাশাপাশি তাঁর কর্মক্ষমতা ঈর্ষণীয়। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই এমন কর্মসক্ষমতা পায়। ৮২ বছর বয়সেও তিনি যে পরিমাণ কাজ করেন, তা শুধু যে কোন তরুণের জন্য লজ্জার নয়- আমাদের যাদের পৃথিবী খুব ছোট আমরা এমন কর্ম-সক্ষমতা খুবই কম দেখেছি। শুনেছি এবং পড়েছি রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছরেও এমন পরিশ্রমী ছিলেন। আর চোখে দেখার ভেতর অমর্ত্য সেনকে দেখেছি। ২৫ তারিখ গভীর রাত অবধি তাঁর সঙ্গে হাসিনা মডেল ও এবারের বাজেট নিয়ে কথা হয়। তাঁর কাছ থেকে যে বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করি তা বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক বড় পরিসরে লিখতে হবে। তবে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে ও এবারের যে বাজেট আসছে তার চরিত্রের ভেতর দিয়ে হাসিনা মডেলের যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে প্রথমেই হাসিনা মডেলের যে বিষয়টি সামনে আসে তা ‘প্রাকৃতিক সম্পদের বদলে মানব সম্পদ’। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, এবারের বাজেটে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে মানব সম্পদে, যার একটি অংশ মানসম্পন্ন মাধ্যমিক শিক্ষা। এখানে তিনি জানান, শেখ হাসিনা চান গ্র্যাজুয়েশন অবধি ফ্রি এডুকেশান। কিন্তু বাজেটের সম্পদ বণ্টনের সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি এখনই উচ্চ মাধ্যমিকের ওপরে ফ্রি এডুকেশানের ব্যবস্থা করতে পারছেন না। তবে তিনি জানান, খুব শীঘ্রই তাঁকে গ্র্যাজুয়েশান অবধি ফ্রি এডুকেশানের ব্যবস্থা করতেই হবে। কারণ তাঁর নেত্রী শেখ হাসিনা এটা দ্রুত বাস্তবায়ন চান। শেখ হাসিনার বিশ্বাস দেশের জনগোষ্ঠীকে দ্রুত উচ্চশিক্ষিত করতে পারলেই উন্নয়ন দ্রুত হবে। আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায়, জাতিকে শিক্ষিত করার বিষয়ে শেখ হাসিনা আপোসহীন এবং এখানে তাঁর কোন ছাড় নেই। শিক্ষায় বিনিয়োগকে তিনি সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। যে কারণে যদিও বিদ্যুত ও কমিউনিকেশান অবকাঠামোয় ধারাবাহিক বড় বরাদ্দ থাকছে তারপরও এবারের বাজেটে সব থেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে মানব সম্পদ ও সেকেন্ডারি এডুকেশান উন্নয়ন। মুহিত তাঁর বাজেটে এবার মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের চরিত্র বদলে দিচ্ছেন। তিনি আর শুধু শিক্ষকের বেতনের ভেতর বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখবেন না। তিনি প্রতিটি স্কুলের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নের ব্যবস্থা করবেন। অর্থাৎ শিক্ষকের ট্রেনিং, স্কুলের ল্যাবরেটরি, স্পোর্টস, স্কুল অবকাঠামো সবদিকে নজর দেয়া হবে। অর্থাৎ শেখ হাসিনা যে ফ্রি গ্র্যাজুয়েশানের ব্যবস্থায় যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন- আবুল মাল আবদুল মুহিত সেখানে এমনভাবে পৌঁছতে চান, যাতে ভবিষ্যতে ভাল গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয়। শেখ হাসিনার এই ফ্রি গ্র্যাজুয়েশান কর্মসূচী ভাবলে আসলে কিন্তু বিস্মিত হতে হয়, কী সাহসী ও দেশপ্রেমের সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে বসে আছেন। আমেরিকার কলেজ শিক্ষাকে ফ্রি করতে সেদেশে বছরে প্রয়োজন হয় ৭০ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের সামরিক বাজেটের দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। কিন্তু তা সেখানে দুঃস্বপ্ন আর শেখ হাসিনা সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবে শেখ হাসিনার এই রূপরেখা ও মুহিতের এই কর্মপরিকল্পনা থেকে স্পষ্ট হয় হাসিনা মডেলের এই অন্যতম চরিত্রটি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার মূল সূত্রটি আবিষ্কার করেছেন। কারণ তিনি জানেন, সম্পদ ছাড়া কোন দেশের টেকসই উন্নয়ন হয় না। তিনি সেই সম্পদ তৈরি করছেন। দরিদ্র বাংলাদেশের একটাই মাত্র কাঁচামাল (অর্থনীতির ভাষায়) আছে তা মানুষ। এই মানুষ যতক্ষণ অদক্ষ ও অশিক্ষিত থাকবে ততক্ষণ তারা অর্থনীতিতে অব্যবহৃত বা অপ্রয়োজনীয় কাঁচামাল। একেই শেখ হাসিনা শিক্ষা দিয়ে সম্পদে পরিণত করার কাজে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন। এই দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষই হবে তাঁর অন্যান্য দেশের তেল, গ্যাস, কয়লা ও বনজ সম্পদের বিপরীতে সম্পদ। হাসিনা মডেলের এ শিক্ষায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ও তার গতিপ্রকৃতি দেখে এ চিন্তার সঙ্গে কেবল মিল খুঁজে পাওয়া যায় প-িত জওয়াহেরলাল নেহরু ও তাঁর সহযোদ্ধা প্রশান্ত মহলানবিশের। অশিক্ষা, ধর্মীয় জাত-পাত, কোন্দল ও দারিদ্র্যপীড়িত জনভারে ভারক্রান্ত ভারতের দায়িত্ব নিয়ে প-িতজী কিন্তু সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছিলেন শিক্ষায়, যার কারণে আজ পৃথিবীর সব থেকে বড় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভারতে। বিশ্ব অর্থনীতির একটি সম্মানজনক স্থানেও ভারত। তাই নেহরু শুধু স্বাধীন ভারত সৃষ্টির ফাদার ফিগার নন, অর্থনৈতিক ভিত্তির ও মডেলের স্থপতিও তিনি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত শেখ হাসিনার এ শিক্ষায় বিনিয়োগ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার একজন অনন্য ও সঠিক কারিগর। কিন্তু শেখ হাসিনা যে গতিতে তাঁর এই অর্থনৈতিক মডেলে শিক্ষিত মানব সম্পদ তৈরি করতে চাচ্ছেন- এই গতিতে সঠিকভাবে এগোতে হলে তাঁকে একটু জওয়াহেরলাল নেহরুর কেবিনেটের দিকে তাকাতে হবে। জওয়াহেরলাল নেহরুর কেবিনেটে শিক্ষামন্ত্রী প্রথমে ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও পরে অসামান্য মেধাবী ও শিক্ষিত হুমায়ুন কবির। শেখ হাসিনা মডেলের এই অন্যতম কাজটি করতে হলে হাসিনা ও মুহিতের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে পারেন এমন যোগ্য ও শিক্ষিত লোককেই তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য খুঁজতে হবে। আর তা যদি সম্ভব হয়, তাহলে শেখ হাসিনার কাক্সিক্ষত সময়েই তাঁর মডেলের এ কাজটি সম্পন্ন হতে কোন বাধা পাবে না। হাসিনা মডেলের আরেকটি অন্যতম দিক হলো অবকাঠামো উন্নয়ন। তা বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এই অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে শিল্পায়নকে মাথায় রেখে। শিল্পায়নে বাংলাদেশে সব থেকে বড় সমস্যা জমি। বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলার মতো জমি এখন কমে গেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানালেন, কৃষিজমি আর খুব বেশি বাংলাদেশে শিল্পের কাজে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নীতি হচ্ছে, ইকোনমি জোনগুলোর জমিই হবে বাংলাদেশের শিল্পের জন্য জমি। যেমন একটি উদাহরণ তিনি দেন মাতার বাড়ি। এছাড়া তিনি বলেন, বিভিন্ন আইল্যান্ডগুলোই হবে মূলত বাংলাদেশের ইকোনমি জোন। সেখানকার জমি শিল্পে ব্যবহৃত হবে। দেশের এই দ্বীপগুলোকে শিল্পের জন্য অর্থনৈতিক জোন হিসেবে তৈরি করার পথে শেখ হাসিনা যে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং একটি জনঘনত্বপূর্ণ ও কম জমির দেশকে শিল্পায়নের পথে নেয়ার যে কঠিন পথে তিনি সফল হতে চলেছেন- এ একদিনে হয়নি। এখানে পৌঁছতে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছে তাঁর গত পাঁচ বছরের কিছু সাহসী পদক্ষেপ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও হাসিনা মডেলের দিকগুলো আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, হাসিনা মডেলের অন্তর্নিহিত বড় শক্তি, শেখ হাসিনার সাহস, সিনসিয়ারিটি ও তাঁর সততা। শেখ হাসিনার ধারেকাছে কোন সাহসী মানুষ এ মুহূর্তে শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সরকার প্রধানদের ভেতরও যে নেই, তার প্রমাণ শেখ হাসিনা রেখেছেন। আর শেখ হাসিনার সততা সম্পর্কে আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, তাঁর সব থেকে বড় গুণ হলো ছোটবেলায় তাঁর যে লাইফস্টাইল ছিল এখনও তাই আছে। জীবনে তিনি চাহিদা বাড়াননি। তাছাড়া তাঁর দাদার রেখে যাওয়া যথেষ্ট সম্পদ আছে। বঙ্গবন্ধুও সারাজীবন তাঁর বাবার সম্পদে চলেছেন। শেখ হাসিনারও অসুবিধা হয় না। শেখ হাসিনার এই সততা ও সাহসই বাংলাদেশকে আজ এই শিল্পায়নের স্বপ্ন শুধু নয়, বাস্তবতায় এনে দাঁড় করিয়েছে। শেখ হাসিনা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা নেন ২০০৯ সালে তখন দেশের বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ২৭০০ মেগাওয়াট, যা দিয়ে একটি দেশের শিল্পায়ন তো দূরে থাকুক হেঁসেলেও আলো জ্বালানো সম্ভব নয়। ওই মুহূর্তে দেশে দ্রুত বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য শেখ হাসিনা যে বিশেষ দ্রুত বিদ্যুত আইন করেন, তা সাহস ও সততা ছাড়া সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা ওই বিদ্যুত আইন তৈরির সময় বলেছিলেন, দেশের জন্য দ্রুত বিদ্যুত তৈরি করতে গিয়ে যদি আমাকে ফাঁসিতে যেতে হয় তাও যাব। কারণ এখানে আমার কোন স্বার্থ নেই, এটা দেশের জন্য। আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ ও মৌলবাদপুষ্ট, উলফাপুষ্ট মিডিয়া সেদিন এ নিয়ে অনেক সমালোচনা করে। অনেক অপপ্রচার করে। অতি উৎসাহী আনু মুহাম্মদ গ্রুপতো তাঁকে হেন গালি নেই যে দেয়নি। এই সব অতি ক্ষুদ্র হুলযুক্ত কীটদের দিকে শেখ হাসিনা না তাকিয়ে দেশের জন্য বিদ্যুত উৎপাদন করেছিলেন। দ্রুত বিদ্যুত আইনের মাধ্যমে ছোট বিদ্যুত কেন্দ্রের পরে আজ তিনি মাতারবাড়ি বিদ্যুত হাবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, ফলে শিল্পায়ন এখন বাংলাদেশের বাস্তবতা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানালেন, বিশেষ করে জাপান, চীন, কোরিয়া ও ভারত এই চারটি দেশ এখন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। সেভাবেই বিষয়টি এগিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সেদিনের সাহসী সিদ্ধান্তই দেশকে এখানে নিয়ে এসেছে। পৃথিবীতে বীর ছাড়া কখনও কোন যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হতে পারে না। আর সাহস ছাড়া বীর তো চাঁদ ছাড়া চন্দ্রালোকিত রাতের কল্পনা। বাংলাদেশের ভাগ্য দীর্ঘ সামরিক শাসন ও অপশাসনের পর অর্থনৈতিক যুদ্ধে শেখ হাসিনার মতো বীরকে তাদের নেতা হিসেবে পেয়েছে। এখন হাসিনা মডেলে কিভাবে দেশে শিল্পায়ন হচ্ছে ও হবে তাও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা সেই পর্যায়ে দেশকে নিয়ে এসেছেন। খুব সংক্ষেপে বিষয়টি, যাতে শিল্পায়ন ভার্টিকালি হয় অর্থাৎ জমি কম লাগে অথচ আয় বেশি হয় সেদিকেই নজর দিচ্ছেন। একদিকে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন ভারি প্রোডাক্ট উৎপাদন, অন্যদিকে ঘরে ঘরে ছোট যন্ত্রাংশ বা নিত্যপণ্যের উৎপাদন। এ কলামে আগেও লিখেছি, আগামী ২০২৫ সালে দেশে বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে ৫০ হাজার মেগাওয়াট। কারণ ততদিনে চীন ও ভারতের যাবতীয় ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশের ইন্ডাস্ট্রিগুলো বাংলাদেশে শিফট করবে। তখন ঘরে ঘরে ছোট ছোট ইন্ডাস্ট্রি হবে। শেখ হাসিনা মডেল কিন্তু দেশকে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যুতে চীন, ভারত, জাপান বাংলাদেশে এসে গেছে ও আরও আসবে। জাপানের হোন্ডা কোম্পানি এসেছে। জাপান যে শুধু হোন্ডা কোম্পানির স্কুটার নয়, নানান কোম্পানির গাড়িসহ আরও অনেক অর্থনৈতিক মূল্য বেশি এমন পণ্য উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে আসবে- এ কথা ২০১২ সালে তৎকালীন জাপানের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় জানতে পারি। তিনি বলেছিলেন, বিদ্যুত ও অন্যান্য অবকাঠামো বাংলাদেশে যেভাবে এগোচ্ছে তাতে জাপান তার অনেক বড় বড় শিল্প বাংলাদেশে নিয়ে যাবে। কারণ তাঁর হিসাবে বাংলাদেশে ৫ কোটি তরুণ জনশক্তি আছে, যা একটি দেশের জন্য বিশাল সম্পদ। শেখ হাসিনা মডেল এমনিভাবে বাংলাদেশকে জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পুঁজির কাছে প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আর এ পথ বেয়ে হাসিনা মডেল বাংলাদেশে শিল্পায়নে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শেখ হাসিনা অস্ত্র রফতানির জন্যে অস্ত্র উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন কথাটা বললে, অনেকেই রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের সেই মন্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। ভাবখানা তেমনই হয়, আমারও ছিল মনে...। যা হোক, তারপরও বলি, অনেকদিন থেকে মনে করেছি এ কলামে লিখি বাংলাদেশের রফতানির জন্য অস্ত্র উৎপাদনে যাওয়া উচিত। কারণ এত কম পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে এত বেশি অর্থ আয় করার শিল্প পৃথিবীতে খুবই কম। তাছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে শেখ হাসিনা তাঁর দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারতের সঙ্গে যেভাবে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলছেন তাও কূটনীতির ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। এ অবস্থায় বহির্শত্রুর দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা বাংলাদেশের নেই। পক্ষান্তরে যে দুটি আঞ্চলিক ও বিশ্বমাপের সামরিক শক্তিশালী দেশ বাংলাদেশের প্রতিবেশী, তারা কিন্তু ভবিষ্যতে বাংলাদেশের তৈরি অস্ত্রের বাজার হবে। এ কারণে শেখ হাসিনার এই রফতানির জন্য অস্ত্র উৎপাদনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তাছাড়া বাংলাদেশের কিছু ভারি সমরাস্ত্রের প্রয়োজন হবে, তা যুদ্ধ করার জন্য নয়, সমুদ্রসীমা পাহারা দেয়ার জন্য। সেই ভারি অস্ত্র তৈরিতে যদি বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সক্ষম হয়, তাহলে সেখানে আরও কিছু বেশি উৎপাদন করে রফতানিতে গেলে অর্থনীতিতে বড়মাপের যোগই ঘটবে। হাসিনা মডেল দেশের অর্থনীতিকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনাই প্রথম সরকার প্রধান, যিনি বুঝেছেন বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নৌবাহিনী প্রয়োজন। তা যুদ্ধের জন্য নয়, সমুদ্র সম্পদ রক্ষার জন্য। যে কারণে ১৯৯৬ সালে স্বল্প মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় এলেও তিনি নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে হাত দেন। আর ২০০৯ থেকে তিনি তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞের মধ্যে এটাও ফেলেছেন। শেখ হাসিনার মতো এমনি যারা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপকার হন তাদের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু অর্থনৈতিক কাজগুলোর ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে একটি সমন্বিত চিন্তা করেন। তাই সাধারণ রাজনীতিক থেকে শুরু করে অর্থনীতির বই পড়া অর্থনীতিবিদ বা শিক্ষকরা তাঁকে বুঝতে পারেন না। শেখ হাসিনার এই উন্নয়নের মডেল অর্থাৎ হাসিনা মডেলের একটি বড় দিক হলো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক-কূটনীতিক সাফল্য ও সামাজিক চিন্তা, যা বিস্তারিত লেখা এ কলামে সম্ভব নয়, এমনিতে পরিসর বড় হয়ে গেছে। তবে শেখ হাসিনা তাঁর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রথমে গিয়েছেন তিনি ও বাংলাদেশ যার সন্তান সেই শেখ মুজিবের কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কাছে। অর্থাৎ দেশের আয়তন বাড়াতে হবে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিলেন। শেখ হাসিনা দেখেছেন ১৬ কোটি মানুষের জন্য তিনি জমি বাড়াতে পারবেন না; কিন্তু সমুদ্রসীমা বাড়াতে পারবেন। ক্ষমতায় এসে তাই বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে তিনি সেদিকে মনোযোগী হন। তাঁর এই দুইবারের ক্ষমতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের থেকে বেশি আয়তনের সমুদ্রসীমা তিনি বাড়িয়েছেন, যা ছিল এক কথায় চানক্য কূটনীতি। এই সমুদ্রসম্পদ পাওয়ার ভেতর দিয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে প্রাকৃতিক সম্পদ, বড় একটি নেভাল ফোর্স এবং রফতানিযোগ্য ভারি অস্ত্র শিল্প, যা হবে হাসিনা মডেলের তৃতীয় অধ্যায়। তবে এই যে হাসিনা মডেল একের পর একটা অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এ সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ চেনেন বলে। যেমন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অনেকবার বলেছেন, আজকের এই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, চাল আমদানিকারক দেশ থেকে রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার মূলে শেখ হাসিনা। ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি তাঁকে বলেছিলেন, আপনার মন্ত্রণালয়ে যা প্রয়োজন আমি তাই দেব। দেশকে দ্রুত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করুন। শেখ হাসিনা বাঙালী ঘরের মেয়ে ও বধূ তাই অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা মতিয়া চৌধুরীকে সহজে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, দেখুন গৃহস্থের যদি গোলা ভরা ধান থাকে তাহলে সে নিশ্চিন্তে সব কাজ করতে পারে। ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যেই শেখ হাসিনা সেই কাজটিই মতিয়া চৌধুরীকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। তাই আজ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক সাফল্যের শিখরের দিকে যাচ্ছেন হাসিনা। কারণ তিনি নিশ্চিন্ত গৃহস্থ। তার বাড়িতে কেউ না খেয়ে থাকবে না। এজন্য নিরবচ্ছিন্ন গতিতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে হাসিনা মডেল। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানালেন, ২০১৮-১৯ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে ১৫ থেকে ১৬ পার্সেন্টে। কোন দেশে দারিদ্র্যের হার ১৫ পার্সেন্টে নেমে এলে ওই দেশকে আর দরিদ্র দেশ বলা হয় না। কারণ যে কোন দেশে ১৪ থেকে ১৫ ভাগ মানুষ আয়ের বাইরে থাকে। এরা শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী। তবে দরিদ্ররাও শেখ হাসিনা মডেলে উপেক্ষিত নয়। কারণ আবুল মাল আবদুল মুহিতের গত ছয়টি বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় হয়েছে এক লাখ বাইশ হাজার ছয় শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মতো একটি জনভারসমৃদ্ধ দেশ মাত্র ১০ বছরে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়া কি বিস্ময়কর নয়? তখন কি পৃথিবীর বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের পাঠ্য হবে না ‘হাসিনা মডেল’? সেদিন জানিনা কোন শিক্ষক এ কথা তাঁর ক্লাসে বলবেন কিনা, বাংলাদেশের এক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সে দেশের দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাতে চেয়ে শেষ অবধি তিনিই জাদুঘরে গেছেন। আর তার যত অভিযোগ ছিল যে রাষ্ট্রনায়কের বিরুদ্ধে, যার বিরুদ্ধে তিনি পৃথিবীব্যাপী নালিশ করে বেড়িয়েছিলেন- তিনিই দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠিয়েছেন। কারণ ওই রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম শক্তি ছিল তাঁর সততা ও সাহস। [email protected]
×