ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পথ বেঁধে দিক ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২৭ মে ২০১৫

পথ বেঁধে দিক ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’

গারো তরুণীটিকে ধন্যবাদ। তিনি তাই করেছেন যা তার করার কথা। এ সমাজে নারীরা সচরাচর যা করতে পারেন না। রাত এগারোটায় তাকে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। তিনি বাসায় ফিরে স্বজনদের নিয়ে থানায় যান ধর্ষণমামলা করতে। কিন্তু সহজ হয় না তার এ কাজ। পর পর তিন থানা তাকে ফিরিয়ে দেয়। মামলা নেয় না। তাতে হতাশ হন না তরুণী। শেষ পর্যন্ত সফল হন। মামলা দায়ের করতে পারেন। সময় মতো করিয়েছেন মেডিক্যাল চেকআপ। তাতে গণধর্ষণের সত্যতা মেলে। তার এই সাহস এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বর প্রশংসা না করে পারা যায় না। অপরাধ না করেও ধর্ষিত নারীকে যে সমাজে অপরাধীর মতো লুকিয়ে থাকতে হয় সে সমাজের নারী হয়ে তিনি নিজের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়েছেন দৃঢ়ভাবে। একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত এ মামলার গন্তব্য গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করতে পারবে কিনা সে সন্দেহ থেকে যায়। তারপরও তার তৎপরতা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। কারণ প্রচলিত সামাজিক সংস্কারের চাবুকের ভয়ে তিনি পিছিয়ে যাননি। সংস্কারের চাবুক দেখা যায় না। এর পীড়ন অনুভব করা যায়। অদৃশ্য চক্রব্যূহের মতো ঘিরে থাকে। এ থেকে বেরোনো কি সম্ভব একা নারী কিংবা পুরুষের পক্ষে? একেবারেই নয়। সংস্কার তৈরি হয় নারী-পুরুষের যৌথ জীবন ধারায়, উৎপাদন কাঠামোকে কেন্দ্র করে। এ থেকে বেরোতে দু’জনারই সমান আন্তরিকতা প্রয়োজন। নইলে দু’জনার বিকাশই ব্যাহত হয়। নারীর মুক্তি সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না পুরুষেরও মুক্তি হয়। অনেকে নড়েচড়ে বসবেন হয়ত- পুরুষের মুক্তি! কার কাছ থেকে? এর উত্তর প্রচলিত সংস্কার থেকে। গতানুগতিক চিন্তা থেকে। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা মিথ থেকে। পুরুষ প্রচলিত সংস্কারে আচ্ছন্ন থাকবে আর নারী বিকশিত মানুষ হবে- এ অবাস্তব ভাবনা। একজন সংস্কারমুক্ত যৌক্তিক মানুষই আরেকজন মানুষকে যৌক্তিকভাবে বিচার করতে পারে। চিন্তার এ সামগ্রিকতা প্রয়োজন নারী-পুরুষ দুয়েরই। একথা বুঝেছিলেন মেরি ওলস্টোন ক্রাফট। ফরাসী বিপ্লবের আবহে যিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নারীর অধিকার স্বীকৃত হলেও তা বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা কঠিন। আরও বলেছিলেন, ‘নারীর প্রতি প্রত্যক্ষ অপমান ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু নানাবিধ বিশেষণে গালভরা প্রশংসা করে তাকে যে অন্তপুরে রুদ্ধ করে রাখা হয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই কঠিন।’ সেই আঠারো শতকের সমাজ বাস্তবতায় কথাগুলো বললেও একুশ শতকের নয়া উদারবাদী আজকের সমাজেও কথাগুলো সমান প্রযোজ্য। আজকের নারী শিক্ষায়, কাজে অনেক দূর এগুলেও সামাজিকভাবে তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। ১৭৮৯ সালের সেই বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন দিগন্তরেখা স্পষ্ট করে। বিপ্লবের প্রভাবে ফরাসী চিন্তাবিদদের মনে নতুন ভাবধারা জন্ম নেয়। এর প্রভাবে সমাজে আলোড়ন তোলার পাশাপাশি নারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত নারীরা শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে আনেন। তারা বললেন, পরিবারে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা নির্দিষ্ট হতে হবে, সম্পত্তিতে অধিকার দিতে হবে এবং নারীর নিজের রোজগারের ওপর তার অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব দাবি জানাতে গিয়ে একসময় ভোটাধিকারের দাবি সামনে এসে পড়ে। ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন মূলত সম্পদশালী নারীরা। শ্রমিক নারীদের এতে সমর্থন ছিল। ধনী নারী আর শ্রমিক নারীদের স্বার্থ ছিল আলাদা। তাদের দাবি-দাওয়াগুলো সমান্তরালে আবর্তিত হয়নি কখনও। তাদের জীবনধারাই পরস্পরবিরোধী। আজও মধ্যবিত্ত নারীদের আন্দোলন পোশাক কারখানার শ্রমিক নারীদের আন্দোলন থেকে মৌলিক পার্থক্য বজায় রেখে চলছে। কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য যখন হাইকোর্ট রুল জারি করে পোশাক কারখানার হাজার হাজার নারী শ্রমিকের কাছে তখন এই নিপীড়নের চেয়ে বেশি জরুরী হয়ে ওঠে মাস শেষে নির্দিষ্ট সময়ে মজুরি পাওয়া ও ন্যায্য মজুরির বিষয়টি। যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদি নিয়ে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন হলেও ক্ষমতাহীন নারীদের পক্ষে তার সুফল ভোগ করা সম্ভব হয় খুব কম ক্ষেত্রে। ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীদের কঠোর বলয় ভেদ করে ক্ষমতাহীন নারীর পক্ষে আইন-আদালত পর্যন্ত পৌঁছানোই কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এগোচ্ছি ...। আন্দোলনে এগোচ্ছি দলিল দস্তাবেজে এগোচ্ছি। শুধু একটি প্রশ্ন প্রতিনিয়ত পাক খায়- এ চলা আমাদের জীবনের বাস্তবতাকে ছুঁতে পারছে তো? কর্পোরেট ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনের অত্যাধুনিক চেয়ারে বসে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো তরুণ যখন বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে কন্যার বাবার দেয়া ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তরের দিন গুনে প্রসঙ্গটি তখন বড় বেশি প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ হৈমন্তী গল্পে লিখেছেন, ‘কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনরকমে চাপা দেয়ার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনও তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ ওপরে আছে, সেই জন্যই তাড়া।’ শিক্ষায় যোগ্যতায় সমান পারদর্শী মেয়ের বাবা বিয়েতে মেয়েকে সাজানোর জন্য এক সেট গয়না আর যে ঘরে সে যাবে সে ঘর সাজাতে এক সেট ফার্নিচার দেবেনই। যৌতুক নয়, মেয়েকে বাবার দেয়া উপহার! এ উপহার নিতে শিক্ষিত মেয়েটিরও কোন আপত্তি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণী পাওয়া মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রীর বিয়ে হয় ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে লেগেছে’র মতো। তারপর সে মেয়ে স্বামীর হাতে খুন হয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসে। স্বামী গুরুপাপের লঘুদ- নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। এভাবেই চলছে। শোপেন হাওয়ার বলেছিলেন, ‘সন্তানের জন্ম দিয়ে, সন্তান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামতো মত প্রকাশ করতে দেয়া যায় না।’ এক-দু’ শ’ বছর পর আজও কি বাতাসে দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের সেই কথা প্রতিধ্বনি তোলে না? কাকে দুষবÑ ব্যক্তিকে, প্রতিষ্ঠানকে নাকি পদ্ধতিকে। সিস্টেম তৈরি করে ব্যক্তিকে, আবার ব্যক্তি প্রভাবিত করে সিস্টেমকে। যারা ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদের কথা বলেছিলেন অবস্থার দুর্বিপাকে আজ তাদের কণ্ঠক্ষীণ। তবে তারা নারীর কাজকে গৃহের চৌহদ্দি থেকে বের করে সামাজিক শ্রমের মর্যাদা দিয়েছিলেন। সে কথা ভোলা যায় না। শোপেন হাওয়ারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যারা বলেছিল, ‘নারী বাইরের কাজে গেলে সংসার জীবনে সঙ্কট তৈরি হয়, তাই তাদের ঘরেই থাকা প্রয়োজন, ঘরকন্নাই নারীদের একমাত্র কাজ।’ তারা বিলুপ্ত প্রজাতির কাতারে নিজেদের নাম লেখায়নি। বরং ঝাড়ে বংশে শতগুণ বেড়ে অশরীরীর মতো বিচরণ করছে। তাহলে কি চলাতেই ভুল ছিল? দু’জন চলতি হওয়ার পন্থী না হয়ে একাকী পথ চলার আনন্দ খুঁজে নেয়া হয়েছিল? তাও তো নয়। পথের সাথী হয়েছিলেন অনেকে সেই শুরু“থেকে। অনেক বিরোধ থাকার পরও। আজও আছেন চলার সঙ্গী। নইলে এগোনো সম্ভব হতো না। যেটুকু অর্জন তা যৌথ চলারই ফল। নারী এবং পুরুষ দু’জনার যৌথ চলাই কেবল এগিয়ে নেবে সামনেÑ এক শ’ বছর দু’শ’ বছর হাজার বছর। এর কোন বিকল্প নেই। [email protected]
×