ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

শান্তি ও সংহতি বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৭ মে ২০১৫

শান্তি ও সংহতি বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু

বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও-কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করেছিল। তাঁকে শান্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় ছিল শান্তি। তাঁর জীবন ও কর্মে ছিল শান্তি। তিনি ষড়যন্ত্রকারী সন্ত্রাসীদের হাতে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। শান্তিকামী মানবতাবাদী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশে সন্ত্রাস প্রচলন করা হয়েছিল। জঙ্গী তৎপরতার ফলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলেছিল ভয়াবহ সন্ত্রাস। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মন্ত্রিসভার চারজন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে যে বীভৎস সন্ত্রাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার পরিণতিতে পরবর্তীকালে সংঘটিত হয়েছে কিবরিয়া হত্যা, ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, বিচারক হত্যা, গুলিস্তানের শান্তি সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা, কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বিশাল আকৃতির বোমা স্থাপন, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ মানুষ হত্যা, কুষ্টিয়ায় জাসদের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় মানুষ হত্যাসহ অসংখ্য হত্যাযজ্ঞ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে জ্বালাও-পোড়াও, রেললাইন উৎপাটন, গুপ্তহত্যা, অসংখ্য বৃক্ষকর্তন, হেফাজতের সমাবেশকে কেন্দ্র করে জনজীবন অতিষ্ঠকারী সন্ত্রাস ও ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে। তারই রেশ ধরে ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে যানবহনে আগুন-বোমা মেরে মানুষ পোড়ানোর বহ্নি-উৎসব। সন্ত্রাসের বহ্নি উৎসবে জনজীবনে শান্তির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বস্তুত শান্তির মূর্তপ্রতীক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থেকে শান্তি নির্বাসিত হয়েছিল। রাষ্ট্রে তথা সমাজে শান্তি স্থাপন এবং জনগণের মধ্যে সংহতি বজায় রাখা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য। শান্তি ও সংহতির জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি অর্থনৈতিক অন্যটি সামাজিক। ন্যূনতম অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে না পারলে মানুষের মনে শান্তি আসে না। আবার একই রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে পাহাড়সম অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকলে নাগরিকদের সংহতি বিনষ্ট হয়। সৃষ্টি হয় পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ। অর্থনৈতিক দিক থেকে সকলের ন্যূনতম উপার্জন নিশ্চিতকরণ ও বড় রকমের আয়-বৈষম্য দূরীকরণ সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উপায়। সামাজিক দিক থেকে দেখতে গেলে, সকলের প্রতি সকলের সম্মানবোধ এবং পারস্পরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সমাজে শান্তি ও সংহতি বিনির্মাণে অত্যাবশ্যক। ধর্ম, বর্ণ, কৃষ্টি, বিশ্বাস নির্বিশেষে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনের সংস্কৃতিই সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনির্মাণে অবদান রেখে থাকে। এ দুটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল উপপাদ্য। শান্তি-সংহতির মৌলনীতি দুটির প্রতিফলন দেখা যায় বাংলাদেশের মূল সংবিধানে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে চারটি মৌলনীতি নির্ভর সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। চার মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র ও বাঙালী জাতীয়তাবাদ ছিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও জাতীয় পরিচিতিমূলক। বাকি দুটি মূলনীতি ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র আর সামাজিক মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। পঁচাত্তরের সন্ত্রাসী প্রতিবিপ্লবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত এসেছিল সবচেয়ে বেশি। সমাজে শান্তি-সংহতি স্থাপনে নিবেদিত এই মূলনীতি দুটির অনুশীলন বন্ধ করার প্রয়াসে জঙ্গী শাসকরা সংবিধানের বিকৃতি ঘটিয়েছিল। ক্ষমতা জবর-দখলকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় যেমন ছিল হিংস্র, তেমনি সংবিধানের মূলনীতি সংহারেও তারা ছিল নির্মম। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধুর শান্তিপ্রিয়তা ও সংবিধানের মূলনীতি ছিল সমার্থক। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে নিরস্ত্র হয়নি। সংবিধানের মূলনীতি বিকৃত করে জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর শান্তি প্রয়াসকে বুঝতে হলে তাঁর অর্থনৈতিক ও সামাজিক মৌলনীতিকে অনুধাবন করতে হবে। সমাজতন্ত্রের অনেক অপব্যাখ্যা হয়েছিল এদেশে। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র বলতে কি বুঝিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে। সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্র অনুশীলন করে। ষাট-সত্তরের দশকে সমাজতন্ত্রের অতি পরিচিত একটি রূপ ছিল কমিউনিজম। কমিউনিজম পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সকল সম্পদ-সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। নাগরিকবৃন্দ প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ ভোগ করার অধিকার পায়। এতদসত্ত্বেও চীন ও সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিজম পদ্ধতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশের মৌলনীতি সমাজতন্ত্র কোন অর্থেই কমিউনিজম ছিল না। সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় কোথাও কমিউনিজম উল্লেখ করা হয়নি। বরং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ ধারায় সম্পত্তির মালিকানা নীতি পরিষ্কারভাবে বিধৃত হয়েছেÑ “১৩। উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে- ক) রাষ্ট্রীয় মলিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারী খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; খ) সমবায়ী মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সমবায়সমূহের মালিকানা; এবং গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা।” সংবিধানের এই ধারা বাংলাদেশের মূলনীতি সমাজতন্ত্রের স্বকীয় রূপদান করেছে এবং কমিউনিজম থেকে সম্পত্তির মালিকানার অধিকারকে পৃথক করেছে। মালিকানা বিন্যাসের এই রীতি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা বৈষম্য রোধ করতে সহায়ক। সমাজতন্ত্রের পুনর্বিন্যাসিত রূপ ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহে দৃশ্যমান। বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া তথা ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত সমাজতন্ত্রের যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ক্রমপরিশীলিত মানবাধিকার সংবলিত একটি আধুনিক সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তায়। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতামালায় ‘শোষণহীন সমাজ’ এবং ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ কথাগুলো বহুল উচ্চারিত। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ভাবনা প্রকাশে এই শব্দগুলো খুবই উপযোগী। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে সুষম সম্পদ বণ্টন প্রক্রিয়ায় শান্তি ও সংহতি অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এরপর শান্তি-সংহতি অর্জনের সামাজিক উপাদানটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। এই উপাদানটি সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী, বিশ্বাস নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি নাগরিক সংহতি বিনষ্ট করে এবং শান্তি বিঘিœত করে। এতদঞ্চলে ধর্ম নিয়েই সবচেয়ে বেশি হানাহানি হয়েছে। অধিকাংশ দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূলে থাকে ধর্ম বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতা। বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বিভাজন। বিভাজন বিনাশ করে সংহতি। শান্তি নির্বাসিত হয়। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর সামাজিক চিন্তায় উদ্ভাসিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা তিনি মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশ করেছিলেন। ’৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে ও পরে ভারত-পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, যার মূলে ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষ। ধর্মের কারণে হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল শত শত নিরীহ মানুষ। শান্তি ও সংহতি বিনষ্ট হয়েছিল। শান্তি-সংহতি বজায় রাখার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা। এর অর্থ হলো, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই অপপ্রচার শুরু করেছিল। বাংলাদেশ থেকে ধর্ম উঠে যাবেÑ এই মর্মে প্রচার চালাত তারা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতামালায় অনেকবার ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা নয়’। বরং ব্যক্তি ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার সংরক্ষণ করবে। সংবিধানের ২৮(১) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ সংবিধানের ৪১(ক) ও ৪১(খ) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, ‘(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দেশে বহু ধর্ম মতাবলম্বীর একত্রে শান্তিতে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক। ধর্ম-বর্ণ বিদ্বেষে যুগে যুগে অনেক হানাহানি ঘটেছে। বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে অনেক মহান নেতাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিহত হয়েছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। ধর্মীয় উন্মাদনা প্রশমনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রেখে সকল নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকাল শাসনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠন। বাকশাল নিয়ে অনেক সমালোচনা ও অপপ্রচার হয়েছে। সমালোচকরা বাকশাল গঠনকে গণতন্ত্র হত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেউই অনুসন্ধান করে দেখেননি বাকশালের লক্ষ্য কী এবং প্রক্রিয়াইবা কী? বাকশালের সকল কাগজপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। চিহ্নমাত্র রাখা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর মতো বাকশালকেও হত্যা করা হয়েছিল। তা হলে কি বাকশালে জনকল্যাণের কথা ছিল? সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কথা ছিল? প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, পঁচাত্তরপরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল সরকার জনস্বার্থের বিপক্ষে কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তাদের বাকশাল বিদ্বেষ এ প্রক্রিয়ারই অংশ কিনা, পরীক্ষা করে দেখা যাক। বাকশাল প্রক্রিয়ায় সকল দলকে একীভূত করে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয়েছিল। অর্থাৎ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। এ ব্যবস্থা কি অগণতান্ত্রিক? বহু দল ছাড়া কি গণতন্ত্র হয় না? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হলো চীন। তারা তাদের দেশের নামকরণ করেন ‘চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঈযরহধ’ বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে একদলীয় গণতন্ত্র থাকলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে তা অগণতান্ত্রিক হবে কেন? সমাজতন্ত্রের মতো গণতন্ত্রের অনেক কাঠামো রয়েছে। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব মন-মানস দিয়ে স্বকীয় গণতন্ত্র রচনা করেছে। গ্রেট ব্রিটেনে রাজা-রানী রাষ্ট্রপ্রধান আর দেশ পরিচালনা করে বহুদলীয় সরকার, যার প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটিশরা তাদের দেশকে রাজতান্ত্রিক না বলে গণতান্ত্রিক বলে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীই নেই। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তারা এই ব্যবস্থাকে একনায়কত্ব না বলে গণতন্ত্র নামেই আখ্যায়িত করে। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে দেশ পরিচালনা করেন। সেটাও তাদের প্রথাসম্মত গণতন্ত্র। চীন ছাড়া বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে যেখানে একদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। কাজেই একদলীয় শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র থাকে না, এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। বড়জোর বলা যায় যে, আমরা একদলীয় গণতন্ত্রে অভ্যস্ত নই। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন সম্ভবত সাময়িকভাবে এবং কিছু সাংবিধানিক বিধি পালনের সুবিধার্থে। জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করা এর মূল কারণ হয়ে থাকতে পারে। এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সংবিধানের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তিদান করা।’ সংবিধানের ১৫ ধারায় পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মান দৃঢ় উন্নতি সাধন করাকে ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধরনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নিরিখে বাকশাল গঠনের উপযোগিতা বিচার্য। বাকশাল জনসম্পৃক্ততামূলক একটি নিবিড় সমবায় ব্যবস্থা। সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আবাসন ব্যবস্থা একটি অগ্রসর চিন্তা। নিবিড় সমবায় ব্যবস্থায় জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার একদিকে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়, অন্যদিকে নাগরিক সংহতি বৃদ্ধির ফলে জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এসব বিবেচনায় বাকশাল ব্যবস্থায় একনায়কত্বের চেয়ে তৃণমূলে ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক কল্যাণ সূচিত হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক ছিল। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কারাগারে মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর কারাকক্ষের সামনে কবর খোঁড়া হয়েছিল। সেই বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বাকশাল গঠন করেছিলেন, এটা একটা ভ্রষ্টচিন্তা। বঙ্গবন্ধুকে ম্লান করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালিয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রকারীরা। পঁচাত্তরের পর অন্তত ১৫ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ছিল বাংলাদেশে। তাঁকে স্মৃতির অন্তরালে রেখে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী মডেলে রূপান্তরের প্রয়াস ছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের। পাকিস্তানসহ কিছু বিদেশী শক্তির ছত্রছায়া ও অর্থায়ন ছিল সেই ষড়যন্ত্রে। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংহতির প্রতীক, শান্তির প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেমিক শ্রেষ্ঠ বাঙালীদের মৃত্যুবরণের ফলেই সম্ভবত সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালী জাতি ঝিমিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে স্বাধীনতার প্রাণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তি। বঙ্গবন্ধু আবার জেগে উঠবেন ধ্রুব নক্ষত্রের মতো জাতিকে পথের দিশা দিতে। বঙ্গবন্ধু চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে। বঙ্গবন্ধু দিয়েই গেছেন। কিছু চাননি কোনদিন। আজও চান না। কিন্তু বাঙালী জাতির নিজ প্রয়োজনে তাঁকে স্মরণ করতে হবে, অনুসরণ করতে হবে। তা হলেই আজকের সন্ত্রাসকবলিত বিভাজিত বাংলাদেশে সংহতি পুনর্প্রতিষ্ঠিত হবে। শান্তি ফিরে আসবে। জনজীবনে প্রতিফলিত হবে সহনশীলতা, মানবিকতা ও সমৃদ্ধি। তাই বুঝি আগামীর সঙ্কেত দিয়ে কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’। লেখক : অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার
×