ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

‘মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী?’

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৭ মে ২০১৫

‘মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী?’

‘মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী?’ রাম-রাবণের যুদ্ধে এই আক্ষেপ ছিল রামের শত্রুদের। এ যুগে একে একে সাদ্দাম, লাদেন, গাদ্দাফি- হত্যা এবং সারা মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও শত্রুপক্ষ নিধন অথবা পরাজিত করা যাচ্ছে না, তারা কেমন বৈরী? প্রশ্নটা অধুনা তুলেছেন পশ্চিমা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং মিডিয়াগুলোই। বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার আমেরিকা এবং সবচাইতে শক্তিশালী সামরিক সংস্থা ন্যাটোর আজ এই ইমপোটেন্সির দশা কেন? তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে এখন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ মহল ও মিডিয়ায়। ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে যে আইসিস যুদ্ধ শুরু করেছিল, তারা সম্প্রতি ইরাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর রামাদি দখল করেছে। বাগদাদ থেকে তার দূরত্ব মাত্র ৬০ মাইল। তার আগে তারা মসুল নামে আরেকটি ইরাকী শহর দখল করেছে। ইরাকের বিরাট এলাকায় এবং সিরিয়ার অর্ধেকের মতো এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইসিস-এর দখলে এখন ইরাক ও সিরিয়ার যে এলাকা রয়েছে তার আয়তন মধ্যপ্রাচ্যের একটি আরব রাষ্ট্রের সমান। যে কোন সময় আইসিস তাদের দখলীকৃত এলাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি খেলাফত রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে সরকার কায়েম করতে পারে। সিরিয়ার পালমায়রা (চধষসুৎধ) শহরটি দখল করার পর আইসিসের জিহাদিস্টরা দু’হাজার বছরের পুরনো রোমান সভ্যতার নিদর্শনগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। একই সভ্যতাবিধ্বংসী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তালেবানেরা আফগানিস্তানে ২০০১ সালে। হাজার হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শনগুলো তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে তারা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধে জড়িত হয়েছিল। যে কাজটি আইসিস করছে তাদের দখলীকৃত খেলাফত রাষ্ট্রে, তার কোন তুলনা বিরল। তার মধ্যে রয়েছে মু-ুচ্ছেদ, যৌন নির্যাতন, আগুনে পুড়িয়ে মারা ইত্যাদি। আগুনে পুড়িয়ে মারার বর্বর কৌশলটি বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা রপ্ত করেছিল। বাংলাদেশে ইসলামের নাম ভাঙিয়ে এরা কোনদিন ক্ষমতায় এলে বাঙালীর হাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতি যে ধ্বংস করতে চাইবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্যে এই বর্বর ধর্মান্ধদের শক্তি সঞ্চয় ও অভ্যুত্থানের সবচাইতে বড় বাধা ছিলেন ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সেক্যুলার সরকার। লিবিয়ার গাদ্দাফিও লৌহকঠিন হস্তে জিহাদিস্টদের দমন করে রেখেছিলেন। ভ্রান্ত মার্কিন নীতি এই সাদ্দাম হোসেন ও গাদ্দাফির পতন ঘটায় এবং সিরিয়ার সেক্যুলার আসাদ সরকারেরও পতন ঘটাতে চেয়েছিল। আফগানিস্তানে নজিবুল্লার সেক্যুলার সরকারকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমেরিকা তালেবানদের জন্ম দেয় এবং এক সময় তাদের কাবুলে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। তেমনি ইরাকে ও সিরিয়ায় সেক্যুলার রাষ্ট্রনায়কদের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে আইসিসের জন্ম দেয়। এখন তালেবান এবং আইসিস দুই-ই আমেরিকা তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে কলামিস্ট জেমস রুবিন ২৪ মে’র সানডে টাইমস পত্রিকায় লিখেছেন, Thirteen years ago the then Vice President of America Dick Cheney falsely justified the Iraq war by claiming that Saddam Hossain was sponsoring global terrorism. Unfortunately, today Isis- controlled Iraq, really and truly, is the home-address for a terrorist group potentially even more dangerous than the Al-Qaeda or Osama bin Laden. এর সারমর্ম হলো- তেরো বছর আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি বিশ্বে সন্ত্রাস ছড়ানোর নায়ক সাদ্দাম হোসেন এই মিথ্যা অজুহাত তুলে ইরাক যুদ্ধ যুক্তিসঙ্গত করতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত আজকের আইসিস নিয়ন্ত্রিত ইরাক আল কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের চাইতেও অনেক বেশি বিপজ্জনক সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। সাদ্দাম হোসেন পশ্চিমা দেশগুলোর মনে যে ভয় সৃষ্টি করতে পারেননি, সেই ভয় এখন আইসিস সৃষ্টি করেছে। বাগদাদের ৬০ মাইল দূরের গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করেই আইসিস বসে নেই। তারা বাগদাদের দিকে এগুচ্ছে। গত রবিবার লন্ডনের সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, বাগদাদের ব্রিটিশ কূটনীতিকরা ধরেই নিয়েছেন বাগদাদের পতন আসন্ন। তারা এখন বাগদাদ দূতাবাস ত্যাগ করার এবং ত্যাগ করার আগে তাদের গোপন নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তারা দেখছেন, ব্রিটেন ও আমেরিকার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইরাকী সৈন্যরা যুদ্ধে আইসিসের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাদের অনেকে সরকারী সেনাবাহিনী ছেড়ে পালাচ্ছে অথবা জিহাদিস্টদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিচ্ছে। এটা এখন স্পষ্ট মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী এবং ন্যাটো ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট গেরিলাদের হাতে পরাজয় বরণের মতো ইরাকে ইসলামি জেহাদিস্টদের হাতে পরাজয় বরণ করতে পারে। আট মাস ধরে জেহাদিস্টদের ওপর বড় রকমের হামলা চালিয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ২০টি ন্যাটো এবং আরব দেশের সম্মিলিত বিমানবাহিনী এবং স্থলযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে পশ্চিমা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইরাকী ও সিরিয়ান সৈন্যবাহিনী। তবু আইসিসকে পরাজিত করা দূরের কথা তাদের গতিরোধ করা যাচ্ছে না। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সূত্রে বলা হয়েছে, আইসিস এমন সব ভয়াবহ বোমা তৈরি করেছে (ষবঃযধষ ধৎসড়ঁৎু ড়ভ নড়সনং), যা ইরাক যুদ্ধে সাদ্দামের ব্যবহৃত বোমার চাইতেও অনেক বেশি ভয়ানক ও বিপজ্জনক। জেহাদিস্টদের যেসব টেকনিশিয়ান এসব ‘হাইলি সফিসটিকেটেড অস্ত্র’ তৈরি করছে তারা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অথবা ইউরোপিয়ান ইলেকট্রোনিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এই অস্ত্র তৈরির কাজ শিখেছে। তাদের হাতে অর্থ এবং অস্ত্রের কোন অভাব নেই। তাদের হাতে বিমান শক্তি না থাকায় পশ্চিমা হামলা পর্যুদস্ত করতে পারছে না। নইলে এই যুদ্ধের পরিণতি কি হতে পারে তা বলা কষ্টকর হতো না। এই অবস্থায় ওবামা প্রশাসন ও ক্যামেরন সরকারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আইসিস সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য তারা স্থলসৈন্য ব্যবহার করবেন না। কেবল আকাশযুদ্ধেই জেহাদিস্টদের পরাজিত করবেন। তাদের এই আশা সফল হয়নি। অবিরাম আকাশ হামলা এবং আইসিসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করা সত্ত্বেও আইসিস এখনও অপরাজিত। এমনকি তারা যে কোন সময় বাগদাদ দখল করে নিতে পারে এই আশঙ্কায় বাগদাদের ব্রিটিশ দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ দূতাবাস ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা-ভাবনা করছে। অনেক পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সংবাদপত্রের কলামিস্ট এখন আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্থলসৈন্য ব্যবহার না করার ওবামা প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, স্থলসৈন্য বা গ্রাউন্ড ফোর্স ব্যবহার করা হলে আইসিস বহু আগে পরাজিত হতো। সানডে টাইমস পত্রিকায় কলামিস্ট জেমস রুবিন পর্যন্ত লিখেছেন, সাদ্দাম হোসেনকে উচ্ছেদের জন্য আমরা যদি এত বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করতে পারি, তাহলে আইসিসের বিরুদ্ধে সেই বাহিনী নিয়োগে ওবামা প্রশাসনের এত টালবাহানা কেন? কিন্তু গ্রাউন্ড ট্রুপস বা স্থলসৈন্য ব্যবহার করেও যে কোরিয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা জয়ী হতে পারেনি, এমন কি গালফ যুদ্ধেও স্থায়ী সাফল্য অর্জন করতে পারেনি এই সত্যটা এই পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা আড়ালে ঢেকে রাখতে চান। প্রত্যেকটি যুদ্ধে হাজার হাজার নিহত মার্কিন সৈন্যের বডিব্যাগ আমেরিকায় আসতে শুরু করলে যুদ্ধবিরোধী প্রচ- জনবিক্ষোভ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভকে হোয়াইট হাউস ভয় করে। ওবামা প্রশাসন তাই এই ব্যাপারে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। ওবামা চান না আইসিসের সঙ্গে যুদ্ধে হাজার হাজার মার্কিন সৈন্য নিহত হোক এবং তার দেশে প্রবল গণবিক্ষোভ দেখা দিক। তাই আইসিসের সঙ্গে যুদ্ধে নামার শুরুতেই তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। অর্থাৎ আকাশযুদ্ধে সহসা যে জয়ী হওয়া যায় না এই সত্যটা তিনি জানেন। আইসিস বাহিনী গঠনে প্রথমদিকে মার্কিন মদদ ছিল। তারা চেয়েছিলেন, আইসিস সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন ঘটাক এবং ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি এলাকা নিয়ে একটি সুন্নিরাষ্ট্র গঠন করুক, যাতে ইরাক বিভক্ত হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদে লিপ্ত হবে। তাতে ইসরাইলের নিরাপত্তা বাড়বে এবং মার্কিন আধিপত্য রক্ষা পাবে। পেন্টাগনের এই হিসেবে গলদ ছিল। আমেরিকা ও সৌদি আরবের অর্থ আর অস্ত্র সাহায্যে বলীয়ান হয়ে আইসিস যে গোটা ইরাক ও সিরিয়া দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে এবং সেজন্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নামতে পারবে এই হিসাবটা ওবামা প্রশাসনের কাছে ছিল না। তাছাড়া পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কেবল আইসিসের নয়, এই যুদ্ধ মৃত ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনেরও। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলে সাদ্দাম হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি পশ্চিমা শক্তিকে যুদ্ধ কাকে বলে দেখিয়ে দেবেন। এটা তার অসার উক্তি ছিল না। তার হাতে গড়া ‘রিপাবলিকান গার্ড’ নামে পরিচিত সেনাবাহিনী ছিল দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী। কিন্তু এই সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে ব্যবহার করার হুমকি দিলেও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম তা করেননি। কেন করেননি, তা পশ্চিমা শক্তিবর্গের কাছেও এক পরম রহস্য। আমেরিকা এখন স্বীকার করে তার সবচাইতে বড় ভুল প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার পর এই রিপাবলিকান গার্ড নামক সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেয়া এবং তাদের রণকুশল সেনা অফিসারদের তাড়িয়ে দেয়া। জানা যায়, এই রিপাবলিকান গার্ডের সেনাবাহিনী ও অফিসারেরা এখন আইসিসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়ছে। খেলাফত প্রতিষ্ঠা তাদের প্রধান লক্ষ্য নয়, তাদের প্রধান লক্ষ্য আমেরিকার বিরুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের অসমাপ্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সাদ্দাম রাজনৈতিক বিশ্বাসে সেক্যুলার ছিলেন, কিন্তু আইসিস ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রিপাবলিকান গার্ডের সেনা ও সেনা অফিসারদের কাছে এই পার্থক্য এখন গৌণ। তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ করার এবং তার পরবর্তী প্রত্যেকটি ভুলের খেসারত এখন ওয়াশিংটন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা দিচ্ছে। আল কায়দা, তালেবান, আইসিস এসব দানব আমেরিকার সৃষ্টি। এখন নিজের সৃষ্টির সাথে যুদ্ধরত আমেরিকা। কম্যুনিজম এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করতে গিয়ে আমেরিকা যে দানবের জন্ম দিয়েছে তার শত্রুতা সোভিয়েত ইউনিয়নের চাইতেও ভয়ঙ্কর। মধ্যপ্রাচ্যে যদি আইসিস যুদ্ধে জয়ী হয় তাহলে মানবতা ও মানব সভ্যতা এক ভয়ঙ্কর হুমকির সম্মুখীন হবে। আর আমেরিকা জয়ী হলে বিশ্বময় নব্য ফ্যাসিবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা (ঘবি ডড়ৎষফ ঙৎফবৎ) অনিবার্য হয়ে উঠবে। এখন প্রশ্ন, বিশ্বশান্তি ও মানব সভ্যতা তাহলে রক্ষা পাবে কোন্ পথে? লন্ডন, ২৬ মে মঙ্গলবার, ২০১৫
×