স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী নাজমুল হুসাইন। বাংলাদেশ বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে টানা ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কণ্ঠ দিয়ে আসছেন। শত শত বাংলা চলচ্চিত্রসহ অগণিত বিজ্ঞাপনচিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ এ শিল্পী বর্তমানে নামকাওয়াস্তে কিছু অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাচিকশিল্প এবং শিল্পীদের নিয়ে কথামালায় উঠে এসেছে বাচিকশিল্পীদের অবহেলার চিত্র। সম্প্রতি এ শিল্পীর সঙ্গে তাঁর শিল্পী জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়।
এফএম রেডিওগুলো আসার পর বাংলাদেশ বেতার বেশ পিছিয়ে পড়েছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
নাজমুল হুসাইন : বর্তমানে যেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশ বেতারে কাজ করছেন তাঁদের অনেকে মনে করেন, কাজ হোক না-হোক, মাস শেষে তাঁরা তো বেতন পাবেনই। ফলে বেতারের কারিগরি দিকে তাঁরা নজর কম দেয়া শুরু করেছেন। অনুষ্ঠানের নান্দনিকতা, গুণাগুণ, উপস্থাপনা সব ঠিক থেকেও বাংলাদেশ বেতার পিছিয়ে গেল। এই সুযোগটা নিচ্ছে এফএম রেডিও। আমি মনে করি, বেতারে যদি উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীল কিছু কর্মকর্তা থাকতেন তাহলে বেতারকে পেছনে ফেলা এফএম স্ট্যাশনগুলোর জন্য খুব কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী?
নাজমুল হুসাইন : ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার এই বাজারে বাংলাদেশ বেতারে দরকার উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন কর্মী, যাঁরা বেতারকে বিপন্ন দশা থেকে রক্ষা করবেন। আশা করি, দেশের অগণিত শ্রোতা বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গেই থাকবেন। আর বেতারের বিজ্ঞাপনী অনুষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যারা অনুষ্ঠানের স্পন্সর করবেন তাদের মনে বাংলাদেশ বেতার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ বেতার স্বেচ্ছায় যোগাযোগ করতে পারে। যেটা আগে করা হতো, এখন হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশ বেতারের মার্কেটিং পলিসিতে বেশ দুর্বলতা ও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করি। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, কোন পণ্যের প্রচার বা প্রসারের জন্য বাংলাদেশ বেতার এখনও একটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম।
শুনেছি বেতারের হীরকজয়ন্তীতে উৎসবে আপনাকে ডাকা হয়নি?
নাজমুল হুসাইন : হ্যাঁ। নিতান্ত সৌজন্যতায় ওই উৎসবের একটি কার্ড আমাকে পাঠানো হয়েছে বৈকি! তবে মূল উৎসবে একবারের জন্যও আমাকে ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি বেতার কর্তৃপক্ষ। অথচ ‘সিলভার জুবিলি’ উৎসবে পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল আমার ওপরই। বেতারের কথা না হয় বাদই দিলাম। সেটা তো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বন্দী। কিন্তু দেশে এতসব টেলিভিশন চ্যানেল হলো। সেখানে কতরকম অনুষ্ঠান হচ্ছে। অথচ আজ পর্যন্ত একটা অনুষ্ঠানেও উপস্থাপনা করার সুযোগ পেলাম না। শুধু আমি নই আমার মতো অনেক বাচিকশিল্পীই আজ অবহেলিত। শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যমের লোকদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
আপনি তো চলচ্চিত্র প্রচারে বাণিজ্যিক বিষয়ে উপস্থাপনা করতেন?
নাজমুল হুসাইন : করতাম। চলচ্চিত্রে এখন আর আগের মতো পরিস্থিতি নেই। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। সেই চলচ্চিত্র গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে বিজ্ঞাপনের কোনো প্রয়াসও দেখি না। কেউ আমাকে আর আগের মতো ডাকার প্রয়োজনও মনে করে না।
আপনার বর্তমান ব্যস্ততা কেমন?
নাজমুল হুসাইন : সময় দিতে পারতাম না বলে একটা সময় অনেক বিজ্ঞাপন ফিরিয়ে দিয়েছি। আর এখন দুটো মাত্র বেতার অনুষ্ঠানের কাজ করে জীবন চালাচ্ছি। তাও ঠিকমতো পয়সা পাই না; পারিশ্রমিক বাকি পড়ে যায় ছয় থেকে আট মাসেরও বেশি। চাকরি করিনি কখনও, ব্যবসা যা করেছিলাম তাও ছিল ক্ষণস্থায়ী। হিসেবি নই বলে, টাকা-পয়সাও সঞ্চয় করিনি ব্যাংকে। জীবনে সঞ্চয় বলতে আমার এই গলাটাই আছে। আজ যদি আমার এ গলাটা নষ্ট হয়ে যায়, কাল থেকে আমি বেকার।
-অঞ্জন আচার্য