ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিথ্যে তথ্য দিয়ে বিএনপি নেতা প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পেলেন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৫ মে ২০১৫

মিথ্যে তথ্য দিয়ে বিএনপি নেতা প্রধানমন্ত্রীর অনুদান পেলেন

ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে ॥ বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় পেট্রোলবোমায় গাড়ি পোড়ানো ও ভাংচুরের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবহন মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেন টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির মানবাধিকার সম্পাদকসহ অন্যরা। সম্প্রতি মালিক নেতারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহনের ভুয়া তালিকা জমা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিয়েছেন। তারা পোড়ানো ও ভাংচুরের যে তালিকা জমা দিয়েছেন তার মধ্যে মাত্র চারটি গাড়ি প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাকিগুলো ভুয়া। এতে অন্য ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাননি। টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির দুই সম্পাদকসহ কতিপয় নেতারা যোগসাজশ করে এসব করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের টাকা সঠিকভাবে বণ্টন না হওয়ায় টাঙ্গাইল পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদিকে মালিক সমিতির দুই সম্পাদক গাজীপুরের চন্দ্রায় একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষতিপূরণের নামে ৮ লাখ টাকা চাঁদা তুলে ভাগবাঁটোয়ারা করার অভিযোগ করেছে সাধারণ মালিকরা। টাঙ্গাইল নতুন বাসটার্মিনালে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানায়, বিএনপি-জামায়াত ২০ দলীয় জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধে ব্যাপকভাবে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা হামলা চালানো হয়। এজন্য গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সরকার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ^াস দেয়া হয়। ফলে অনেক মালিক ঝুঁকি নিয়ে সে সময় গাড়ি চালিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ^াসের প্রেক্ষিতে টাঙ্গাইল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ২৮টি গাড়ির তালিকা তৈরি করে ক্ষতিপূরণের জন্য যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। গত ১৮ মে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে পান মালিকরা। এরপরই অভিযোগ উঠে, সমিতির ১৯ জন মালিকের ২৮টি গাড়ির মধ্যে মাত্র ৪টি গাড়ি প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাকিগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া। সেগুলো হরতাল-অবরোধে কোন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েনি। এসব গাড়ি মেরামতের জন্য বিভিন্ন গ্যারেজ ও দোকান থেকে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হরতাল-অবরোধের সময় টাঙ্গাইলে এত গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জেলা মালিক সমিতি কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৮টি গাড়ির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেন তা আমাদের জানা নেই। ক্ষতিগ্রস্ত এগুলোর অধিকাংশই সমিতির নেতাদের। যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের চেক পেলেন টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির মানবাধিকার সম্পাদক ও টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির (মিনিবাস অংশের) সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম মিটনের ৮টি গাড়ি, সাধারণ সম্পাদক (বাস অংশের) রাশেদুল রহমান তাবিবের দুটি, যুগ্ম সম্পাদক শফিউল আলম তুষার ও শফিকুল ইসলাম, সহসাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক বাসু দেব, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আলী আশরাফ হিটলু ও কার্যকরী সদস্য নুর হোসেনের একটি করে গাড়ি রয়েছে। অথচ হরতাল-অবরোধে গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত অনেক গাড়ির মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষোভ। টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সহসভাপতি আখতার হোসেন বাবু জানান, সোনিয়া এন্টারপ্রাইজের সেলিম মিয়ার চারটি গাড়ি ভাংচুরের শিকার হয়েছে। বিপুল পরিবহনের চারটি, ধনবাড়ির সুলতান ও বিদ্যুতের একটি করে, রশিদ মিয়ার একটি, মাহী পরিবহনের দুটি, জহিরুল ইসলামের একটি ও রঞ্জু মিয়ার একটি গাড়ি ভাংচুর হয়েছে। অথচ তারা কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি। বেশ কিছুদিন আগে গাজীপুরের চন্দ্ররায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় ভাংচুরের শিকার কয়েকটি গাড়িও এই তালিকায় (বিএনপির আন্দোলনের সময় ভাংচুরের তালিকায়) যোগ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ নেয়া হয়েছে বলেও তিনি শুনেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত অপর মালিক ইউসুফ আলী বলেন, আমার দুটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে একটি গাড়ি দু’বার ভাংচুর হয়েছে। কিন্তু আমি কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি। সমিতির দুই সম্পাদকের নেতৃত্বে কতিপয় নেতৃবৃন্দ মিলে ভেতরে বসে গোপনে তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে বেশিরভাগ ভুয়া। তাদের গাড়ি কবে ভাঙা হলো তা আমরা টাঙ্গাইলে থেকেও জানতে পারলাম না। তারাই ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। যারা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তারা হরতাল-অবরোধের সময় কোন গাড়িই মহাসড়কে বের করেনি। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির (বাস অংশ) সাধারণ সম্পাদক রাশেদুর রহমান তাবিব জানান, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির তালিকা পাঠানোর পর মন্ত্রণালয় থেকে অনেক যাচাই-বাছাই করে তারপর চেক দিয়েছে। যার যার গাড়ি তাদের ব্যক্তি নামে চেক হয়েছে। কারো ২০ হাজার, কারো ২৫ হাজার, এভাবে ৪০ হাজার পর্যন্ত টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেছে। মোট কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেছে তা জানা নেই। মন্ত্রণালয় থেকে এসব চেক নেয়া হয়েছে। তিনি দুটি গাড়ি ভাংচুরের ক্ষতিপূরণের চেক পেয়েছেন বলে জানান। টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (মিনিবাস অংশের) ও জেলা বিএনপির মানবাধিকার সম্পাদক নজরুল ইসলাম মিটন জানান, সমিতির ১৯ জন মালিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। আগে ক্ষতিপূরণের খবর সব মালিককে জানানো হয়েছিল। সে সময় তারা অনেকে ঝামেলা মনে করে কাগজপত্র জমা দেননি। ভুয়া তালিকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতিপূরণের চেক আনার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ একেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট। যারা বঞ্চিত হয়েছেন তারাই এসব অভিযোগ তুলছেন। আমি ৮টি গাড়ির ক্ষতিপূরণের চেক পেয়েছি। এসব বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান খান বলেন, তালিকা করার সময় অনেক মালিক অভিযোগই করেননি। তারা ক্ষতিপূরণ কিভাবে পাবেন। তালিকায় দু-একটি ভুল হতে পারে। তবে এটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তাছাড়া ক্ষতিপূরণের জন্য অনেক দরখাস্ত জমা দেয়া হয়েছে। বড় ধরনের কোন ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি।
×