ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিউজিক ভিডিওর নামে এসব কী হচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২৪ মে ২০১৫

মিউজিক ভিডিওর নামে এসব কী হচ্ছে!

সাজু আহমেদ ॥ গান শুধু শোনার বিষয় নয় দেখার বিষয়ও-এই বিষয়টি যখন থেকে চালু হলো তখন থেকেই সম্ভবত গানের সর্বনাশ শুরু। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের মিউজিক ভিডিও। আর মিউজিক ভিডিওর নামে সাম্প্রতিক সময়ের যে অশ্লীতার ছড়াছড়ি তার মূলে ওই গান দেখার বিষয়। এমন মন্তব্য করছিলেন দেশের মিডিয়া সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অডিও অঙ্গনের চিত্র পর্যালোচনা করলে ওই ব্যক্তির বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ের অডিও অঙ্গনে দেখা যায় দেশের অনেক শিল্পীই এখন নিজের গান প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মিউজিক ভিডিওকে বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে নতুনদের সংখ্যাই বেশি। এই সব মিউজিক ভিডিওতে নতুন নতুন মডেলদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অশ্লিল শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এসব শিল্পী কতিপয় নাম সর্বস্ব চ্যানেল এবং ফেসবুকের মধ্যেই তাদের জনপ্রিয়তা সীমাবদ্ধ। এইসব শিল্পী দু’চারটে মিউজিক ভিডিওতে কাজ করে নিজেদের স্টার ভাবছে। অখ্যাত নির্মাতা তাদের নিয়ে নাটক টেলিফিল্ম বানাচ্ছেন নিজেরা জনপ্রিয় হওয়ার জন্য। এতে উৎসাহিত হয়ে অনেক অখ্যাত শিল্পীরাও মিউজিক ভিডিও বানাচ্ছেন। ফলে মৌলিক শিল্পীদের সঙ্গে পরিচালকদের দূরত্ব বাড়ছে। এদিকে কাটতি বাড়াতে অনেকেই অশ্লীল নিম্নমানের মিউজিক ভিডিও তৈরি করছেন। ফলে অশ্লীল এবং নিম্নমানের মিউজিক ভিডিওতে ছেয়ে গেছে বাজার। পাটুয়াটুলিসহ সারাদেশে অখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তথাকথিত মডেলদের দিয়ে এসব ভিডিও নির্মাণ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমনকি এক্ষেত্রে তারা জনপ্রিয় গান বা তার সুর নকল করে এসব ভিডিও নির্মাণ করছে। সমাজে বিশেষ করে যুব সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ বিষয় থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্টরা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছেন। পাশাপাশি চ্যানেলগুলোকে সচেতনতা অবলম্বনের কথা বলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র দেখে মনে হচ্ছে বর্তমানে সম্পূর্ণ মিউজিক ভিডিও নির্ভর হয়ে পড়ছে দেশের অডিও জগৎ। দিনদিন মিউজিক ভিডিওর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন শিল্পীরা। নবীন থেকে শুরু করে প্রবীণ শিল্পীরাও এখন মিউজিক ভিডিও নির্ভর হয়ে উঠছেন। পরিচিত কয়েকটি কথামালার সংমিশ্রণে সুর দিয়ে মিউজিক ভিডিও তৈরিতে নেমে পড়ছে অনেকে। আর এ জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে যত্রতত্র গড়ে উঠছে প্রোডাকশন হাউস। ভুঁইফোড় চিত্র নির্মাতারও অভাব নেই দেশে এখন। জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা বা ঢাকার বাইরে হাজারও প্রতিষ্ঠান এ কাজ করে আসছে। কোন ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই এসব ভিডিও নির্মাণ হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে সংস্কৃতিতেও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক ও কয়েকটি চ্যানেলে যেসব মিউজিক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে সেগুলো যেমন অশ্লীল, তেমনি রুচিহীন। অনেক সময় ওইসব মিউজিক ভিডিওর তথাকথিত মডেলরা গায়ে পোশাক পর্যন্ত রাখতে চান না। এক্ষেত্রে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় এসব ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারাদেশে। একটি সাধারণ ক্যামেরা নিয়েই পরিচালক সেজে যাওয়া এসব মিউজিক ভিডিওর শূটিং স্পট বা কোন নির্দিষ্ট শূটিং জায়গা না থাকায় এদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়াও যায় না। এসব মিউজিক ভিডিওর দর্শক শহরের পাশাপাশি গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা। বিশেষ করে গ্রামের ছোট ছোট দোকানগুলোতে অহরহ প্রচার করা হচ্ছে এসব অশ্লীল মিউজিক ভিডিও। অনেক ক্ষেত্রে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েদের দিয়ে এসব মিউজিক ভিডিওগুলো করানো হচ্ছে। আর এসব ভিডিওর প্রধান ক্রেতা নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু ও বখে যাওয়া যুবকেরা। এসব মিউজিক ভিডিওতে যেসব টেলিফোন নম্বর দেয়া থাকে তা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। এর ফলে এরা সহজেই নিজেদের পরিচয় গোপন করে এসব অবৈধ, অনৈতিক কাজগুলো করে বলে জানা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের একজনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বলেন, এখন মিউজিক ভিডিও মানুষের কাছে গান পৌঁছানোর অনেক বড় একটা মাধ্যম। তাই নতুন গান না করে আগের গানগুলোকে প্রমোট করার চেষ্টা করছি। শুধু এই শিল্পী নয় অনেকেই এই অনৈতিক খেলায় মেতেছেন। ফলে শ্রোতা দর্শকদের কাছে গানের যে মূল আবেদন হারাচ্ছে। সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৌলিক গানের। কারণ এ অবস্থায় মৌলিক গান সৃষ্টি হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে দেশ বরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক শওকত আলী ইমন বলেন, আসলে আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অস্থিরতা চলছে। অন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নিজের মৌলিকত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের সংশ্লিষ্টরা। ভাল কিছু অনুসরণ করা ভাল কিন্তু অনুকরণ করা ঠিক নয়। মিউজিক ভিডিওর কারণে আসলে গানের আবেদন বাড়ার কথা কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো হচ্ছে। নীতি নৈতিকতা বলে একটা জিনিস আছে সে বিষয়টিও সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে। কারণ সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের প্রতি সাধারণ মানুষের আলাদা একটা বিশ্বাস ভালবাসা কাজ করে। সুতরাং এখান থেকে খারাপ কিছু আসলে সমাজে তার প্রভাব পড়বেই। সাম্প্রতিক সময়ে মিউজিক ভিডিও প্রসঙ্গে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী তানভীর তারেক বলেন এই অশ্লীলতার জন্য দায়ী মূলত চ্যানেলগুলো। তারা যদি ভাল ভাল ভিডিও প্রচার অনৈতিক কিছুকে সাপোর্ট না করে তাহলে অনৈতিক মিউজিক ভিডিও মেকাররা এগুলো বানানোর উৎসাহ পাবে না। এছাড়া এ বিষয়ে একটি নীতিমালা হওয়া দরকার যাতে যেনতেন মিউজিক ভিডিওর নামে যাতে কেউ অশ্লীলতাকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে না। তাহলেই নায়লা নাঈম বা হ্যাপির মতো স্বঘোষিত স্টারদের ইমেজ ব্যবহার করে অনৈতিক কিছু সমাজে ছড়াতে পারবে না। এ ছাড়া এ বিষয়টির জন্য কতিপয় অনলাইন পত্রিকাও দায়ী বলে তিনি মনে করেন। জনপ্রিয় তরুণ সঙ্গীত পরিচালক এফ এ সুমন বলেন, মূল সমস্যা আমরা আমাদের মূল সংস্কৃতি থেকে সরে যাচ্ছি। আমাদের যাপিত জীবনের সংস্কৃতি সেটার সঙ্গে মিল রেখেই বা সেটাইর প্রয়োজনীয়তা বা গ্রহণযোগ্যতার কথা মাথায় রেখেই আমাদের কিছু সৃষ্টি করতে হবে। নইলে কেউ সেটা গ্রহণ করবেন না। মিউজিক ভিডিও যদি কথা এবং বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল না রেখে তৈরি করা হয় তাহলে সেই গানের মৌলিকত্ব বলে কিছু থাকে না। তিনি বলে যারা মিউজিক ভিডিওর নামে অনৈতকি কিছু ভিডিও ধারণ করে ছেড়ে দিচ্ছেন তারা অন্যায় করছেন। কারণ তারা আমাদের সঙ্গীত অঙ্গনের জন্য ক্ষতি করছেন। অশ্লীল মিউজিক ভিডিও বা গানের বিষয়ের সঙ্গে সাদৃশ্য নেই এমন যে কোন বিষয়ই আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তবে এ বিষয়ে সব চেয়ে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে সহজলভ্য এ মিউজিক ভিডিও তৈরির নামে দেহব্যবসা চলছে। উঠতি বয়সের মডেলরা বাড়তি রোজগারের আশায় এ পথে আসছে। আর এসব দালালি করে রাতারাতি বিত্তশালী বনে যাচ্ছে অখ্যাত মিউজিক ভিডিওর নির্মাতারা। কথিত নির্মাতার ভিড়ে আজকাল খুব সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মিডিয়াপাড়া। ফেসবুকে খুললেই দেখা যাচ্ছে বহু মিডিয়াকর্মী। চিত্রনাট্যকার, নায়ক, নায়িকা, মডেল, উপস্থাপক, গায়ক, গায়িকা থেকে শুরু করে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও টেলিফিল্ম নির্মাতা কোনটারই অভাব নেই এখন। ভুঁইফোড় হয়ে উঠছে মিউজিক ভিডিও বাণিজ্য। মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ করেই তৈরি করা হয় একটি গানের মিউজিক ভিডিও। বিনিময়ে বিত্তশালী তরুণদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ অবস্থায় সঙ্গীত প্রেমিরা বলছেন গানের ভেতর গানই চাই, কোন অশ্লীল ও রুচিহীন অসুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন দৃশ্য দেখতে চাই না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন তারা।
×