ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বেশিরভাগ প্লট ব্যবহার হচ্ছে আবাসন কাজে

রূপগঞ্জে জামদানি শিল্প নগরী ॥ অবৈধ দখলে

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৪ মে ২০১৫

রূপগঞ্জে জামদানি শিল্প নগরী ॥ অবৈধ দখলে

মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ ॥ জামদানি শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র বিসিক জামদানি শিল্পনগরী। ১৯৯৩-১৯৯৯ সময়কালে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌরসভার নোয়াপাড়ায় ২০ একর জমির ওপর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামদানি শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার ১০ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনের নানা অনিয়ম আর অবৈধ দখলদারদের প্লট দখলের কারণে এই শিল্পনগরী সফলতার মুখ দেখেনি। শনিবার সকালে জামদানি বিসিক শিল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৪০৬টি বেশি মধ্যে ৩৫০টির ও অধিক প্লট শুধু আবাসনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এগুলোতে কোন তাঁত বোনা হয় না। কিছু কিছু প্লট বিভিন্ন কলকারখানার অফিস আবার কিছু প্লট শ্রমিকদের থাকার মেস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধারণক্ষমতার তুলনায় প্রায় ১০ গুণ লোকের বসবাস এখানে। যার কারণে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। রাতের বেলায় এখানে মাদকসেবীদের আসর বসে। অসামাজিক কার্যকলাপেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে যে, স্থাপনাগুলো বিসিক কর্তৃক প্রদত্ত মডেল অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয়নি। ১৫০০ বর্গফুট জায়গায় এক সঙ্গে ৫Ñ৬টি পরিবার বসবাস করেন। শিল্পনগরীর রাস্তা ও ড্রেন জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। অধিকসংখ্যক লোকের বসবাসের কারনে ড্রেনগুলো ময়লায় ভর্তি, পানি নিষ্কাশন ঠিকমতো হচ্ছে না। রাস্তায় ময়লা পানি জমে আছে যা থেকে বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বরাদ্দপ্রাপ্ত জামদানী তাঁতি যারা এখনও জামদানী তাঁতের সঙ্গে জড়িত তারা এসব অরাজক ও অনিয়মের জন্য বিসিকের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। বিসিক জামদানী শিল্প প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আনিসুজ্জামান খোকন এই অরাজক পরিস্থিতির সত্যতা স্বীকার করে স্থানীয় ও বিসিক প্রশাসনের সহযোগিতায় এই অরাজক পরিস্থিতির সমাধান চান এবং শুধু জামদানী শিল্পের জন্য এই শিল্পনগরীকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য কাজ করবেন বলে জানান। বরাদ্দপত্রের নিয়ম মতে বিসিকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কারো কাছে বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের বিধান না থাকলেও দারিদ্রতার কারণে অধিকাংশ তাঁতিই তাদের প্লট অবৈধভাবে অতাঁতিদের কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর করেছেন যা আইনত দ-নীয়। অবৈধ ক্রেতাগণ এখন প্লটগুলো শুধু আবাসনের কাজেই ব্যবহার করছেন। পারিবারিক কুটির শিল্পের অংশ হিসেবে এসব প্লটে তাঁতিদের জামদানী বোনার পাশাপাশি আবাসনের ও সুবিধা আছে। এই সুযোগে অবৈধ ক্রেতারা বসবাস করছেন। পর্যাপ্ত বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের সুবিধা আছে এখানে। পর্যাপ্ত বিদ্যুত, পানি ও গ্যাসের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ ক্রেতারা এই শিল্পনগরীকে পুরোপুরি আবাসিক এলাকায় পরিণত করেছেন। প্লট দখলের অভিযোগ সত্যি কি-না বক্তব্য নিতে চাইলে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁতিরা জানান, বিসিকের অফিস সহকারী আবদুল হকের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এ বিষয়ে আবদুল হক বলেন, প্লট বরাদ্দে অনিয়ম হয়েছে এটা ঠিক না। গরিব তাঁতিরা প্লট পেলেও তারা ঘর তুলতে না পেরে বিক্রি করে দেয়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিসিক কার্যালয়ের সামনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্লটগুলো অবৈধভাবে দখলে নিয়ে স্থানীয় রশিদ মিয়া, জয়নাল মিয়া, সোহরাব মাস্টার, হযরত আলী, রহমান মিয়া, আলী আলম, মোখলেস মিয়া টেক্সটাইল মিল করেছেন। এছাড়া তারাব পৌরসভার মহিলা কমিশনার জ্যোৎস্না বেগম, মিল ব্যবসায়ী নুরু হাজি, গাড়ি ব্যবসায়ী নুরে আলম, টেক্কু মিয়াসহ আরও অনেকে অবৈধভাবে প্লট দখলে নিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। জামদানী তাঁতি হিসেবে জানান দিতে কেউ কেউ নামমাত্র বাঁশ-খুঁটি পুঁতে রেখেছেন। অনেক তাঁতি প্লট না পেয়ে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কথা হয় তেমন একজনের সঙ্গে। আউয়াল আলী নামের এ তাঁতি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কাগজপত্র জমা দিছি। অথচ প্লট পাই নাই। হেই প্লট পাইছে এক ব্যবসায়ী। নুরুল আমিন গত ১১ বছর ধরে ভাড়ায় তাঁত চালিয়ে আসছেন। অথচ তার কপালে জোটেনি প্লট। নুরুল আমিন বলেন, আমরা প্রকৃত তাঁতী অইয়াও প্লট পাই না। আর যেরা তাঁতী না হেরা প্লট পায়।’ জামদানী শিল্পনগরী, বিসিকের সদ্য দায়িত্ব প্রাপ্ত শিল্পনগরী কর্মকর্তা মামুনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অতীতে বিসিকের লোকবল সঙ্কট ও অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ও সুবিধাভোগী লোকজন জামদানী শিল্পের পরিবর্তে শুধু বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে। এ বিষয়ে বিসিক প্রশাসন বেশ সচেতন ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই অবৈধভাবে দখলকৃত ৪৯টি প্লটের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। খুব সত্বরই বিসিক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় প্লটগুলো বিসিকের দখলে আনার ব্যবস্থা করা হবে। পর্যায়ক্রমে অবৈধভাবে দখলকৃত সকল প্লট বিসিকের দখলে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং প্রকৃত জামদানী তাঁতিদের মাঝে এসব প্লট বরাদ্দ দেয়া হবে। এই শিল্পনগরী শুধুমাত্র জামদানী শিল্পীদের আবাসন ও তাঁত বোনার জন্য ব্যবহৃত হবে অন্য কারও আবাসনের জন্য নয়। এ বিষয়ে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন।
×