ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাগরে ভাসমান অভিবাসী উদ্ধারে সর্বাত্মক ব্যবস্থার আহ্বান বান কি মুনের

দেশান্তরী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ মে ২০১৫

দেশান্তরী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর হাতে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এরা বাংলাদেশে আসার পর সরকার তাদের জন্য মানবতা দেখাতে গিয়ে দেশের সুনাম ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ রোহিঙ্গারা দেশান্তরী হতে বাংলাদেশকে টার্গেট করে এর স্থল ও জলসীমা ও আকাশ পথ ব্যবহার করছে অবৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়ে। শুরু থেকে ওরা শরণার্থী হয়ে এদেশে এলেও পরবর্র্তী সময়ে দলে দলে এসেছে এবং এখনও আসছে অবৈধভাবে। এ অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গার বড় একটি অংশ আবারও অবৈধভাবে এদেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ধরা পড়ছে, জেলবন্দী হচ্ছে। পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশী হিসেবে। এরা বাংলা ভাষাভাষী হলেও বাংলাদেশী নয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। এরা বহু আগে থেকেই বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে আছে। কিন্তু শুধুমাত্র তাদের মানবিক অবস্থা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার এদের বিরুদ্ধে আইনগত শক্ত ব্যবস্থা যেমন নেয়নি, তেমনি পুরনোদের ধরে ধরে পুশব্যাকও করেনি। তবে নতুন করে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পথে যারা ধরা পড়ছে তাদেরকে পুশব্যাক করা হচ্ছে। এরপরও নানা ফাঁকফোঁকর গলে রোহিঙ্গারা এদেশে আসা অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাগর পথে দলে দলে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে এদের অনেকে সফলতা লাভ করেছে। তাদের দেখাদেখি আরও অনেকে এ পথে এগুতে গিয়ে মাঝপথে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দী শিবিরে আটকা পড়ে স্থান হয়েছে গণকবরে। গত ১ মে থাইল্যান্ডের গণকবর ও বন্দী শিবিরের ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার হলে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সাগর পথে তাদের কঠোর নজরদারি আরোপ করলে এসব অবৈধ অভিবাসী আন্দামান সাগর হয়ে ইন্দোনেশিয়ামুখী হয়। রোহিঙ্গাদের আবিষ্কৃত এ রুটে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে যারা সফল হয়েছে তাদের মতো বাংলাদেশী হত দরিদ্র শ্রেণীর একটি অংশ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী অবৈধ এ পথযাত্রীদের অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের। নাগরিকত্ব না পেয়ে নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে এদের দেশান্তরি হওয়ার তৎপরতা চলছে যুগ যুগ ধরে। এ দেশান্তরি হওয়ার পথে একমাত্র বাংলাদেশ যাদেরকে শরণার্থী হিসেবে এবং অবৈধভাবে বসতি গড়ার যুগপৎ সুযোগ দিয়ে মানবতা প্রদর্শন করেছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে ভাবমূর্তি রক্ষার ক্ষেত্রে। কারণ, রোহিঙ্গারা বাংলাভাষা তথা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী, শারীরিক কাঠামো ও চেহারাও বাংলাদেশীদের মতো হওয়ায় এরা নিজেদেরকে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তবে বিদেশী কোন রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিদেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগের কথা শুনলে তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দিয়ে ফায়দা হাসিল করতে পিছ পা হয় না। গত একমাস ধরে সাগর পথে রোহিঙ্গা নাগরিকদের মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর তৎপরতা চরম আকার ধারণ করে। ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ৭ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিক সে দেশের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার মিয়ানমারের জলসীমা থেকে উদ্ধার হয়েছে আরও দু’শতাধিক। এছাড়া আরও ৭ সহস্রাধিক এসব অবৈধ অভিবাসী আন্দামান সাগরের বিভিন্ন অংশে ভাসমান অবস্থায় আটকা পড়ে আছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর দেয়া হচ্ছে। এদের উদ্ধারে ইতোমধ্যে ত্রিদেশীয় অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সাগর অভিযান শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে গত শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে এক বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপকে জানিয়েছেন, আন্দামান সাগরে ভাসমানদের অধিকাংশ বাংলাদেশী। অথচ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বলে দেয়া হচ্ছে আন্দামান সাগরে বিভিন্ন নৌকা ও ট্রলারে থাকা নারী, পুরুষ ও শিশুদের অধিকাংশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। এতে বাংলাদেশীদের সংখ্যা খুবই কম। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে উদ্ধারকৃতরা অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান। কিন্তু অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়ার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছেন, আন্দামান সাগরে ভাসমানদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রোহিঙ্গা, বাকিরা বাংলাদেশী। রোহিঙ্গারা দেশান্তরি হয়ে সেদেশে পাড়ি দিয়েছে। আর বাংলাদেশীরা মালয়েশিয়াতে চাকরির খোঁজে দালালদের প্রলোভনে পড়ে সেখানে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। এরা অবৈধ শ্রমিক বা আশ্রয়প্রার্র্থী, কিন্তু শরণার্থী নয়। ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তা হাসান ক্লেইভ সিউলে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপকে বলেছেন, তারা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে উদ্ধারের পর ৬শ’ জনের মধ্যে ৪শ’ বাংলাদেশী পেয়েছেন। জুলি বিশপ এও বলেছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে গিয়ে সেখানে অধিবাসীদের সঙ্গে মিশে পরবর্তীতে চাকরি বা আশ্রয়ের খোঁজে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে চাইছে। উল্লেখ্য, সাগরপথে অবৈধ অভিবাসীদের আশ্রয়প্রার্থীদের জায়গা না দেয়ার নীতিতে বরাবরই কঠোর অবস্থানে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার মতে, এতে মানবপাচার উৎসাহিত হয়। সর্বোচ্চ অধিকার দিতে বান কি মুনের আহ্বান ॥ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আন্দামান সাগরে ভাসমান মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের উদ্ধারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। ভিয়েতনামের হ্যানয়ে অবস্থানরত বান কি মুন শনিবার সাংবাদিকদের একথা বলেন। এ সময় তিনি আন্দামান সাগরের রুট ধরে মানবপাচার বন্ধে আঞ্চলিক সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চড়ে পাচার ঠেকাতে হলে এর মূল কারণ সমাধানে আসতে হবে। প্রসঙ্গত, আগামী ২৯ জুন মানবপাচার বন্ধে ব্যাঙ্ককে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। অনুষ্ঠিতব্য ওই বৈঠকের বিষয়ে ইতিবাচক আশাবাদ ব্যক্ত করে বান কি মুন বলেন, এ সব দেশের সরকারগুলোও একজোট হয়ে কাজ করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, কিন্তু যখন মানুষ সাগরে ভাসছে তখন তাদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। উল্লেখ্য, ইতোমাধ্য সাগরে ভাসমান মানুষগুলোকে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর নেতৃত্বে বহুজাতিক প্রয়াস শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে যুক্তরাষ্ট্রের আবারও আহ্বান ॥ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বসহ যাবতীয় অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে মানবপাচার বন্ধে এগিয়ে আসার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে সাংবাদিকদের সঙ্গে শুক্রবার কথা বলার সময় মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনী ব্লিংকেন এ কথা বলেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের সাগর পাড়ি প্রবণতার পেছনে জাতীয় পরিচয় না থাকাটাও একটি কারণ। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদের বসবাস। বৌদ্ধ মতামতের এ দেশটিতে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত। মিয়ানমারের সরকারের দাবি এরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ওই দেশে রোহিঙ্গাদের বাঙালী নামে অভিহিত করা হয়। সে দেশে বর্তমানে ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। এদের কারও নাগরিকত্ব নেই। এরা সে দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করে আসছে। এ্যান্থনি ব্লিংকেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জীবন ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার ঘটনা বলে দেয় রাখাইন রাজ্যে তাদের কি অবস্থায় দিন যাপন করতে হচ্ছে। নির্যাতন নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে এরা দেশান্তরি হতে বাধ্য হচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে কিছু বাংলাদেশী। ব্লিংকেন বলেন, তিনি শনিবার মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কথা বলার সময় রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগের কারণগুলো তুলে ধরেছেন। তাদেরকে এ কারণগুলো সমাধানের আহ্বানও জানিয়েছেন। ভাসমনাদের উদ্ধারে ক’দিন সময় লাগবে ॥ এদিকে ইউএনএইচসিআর-এর পক্ষ থেকে শনিবার জানানো হয়েছে, আন্দামান সাগরে ছড়িয়ে থাকা মিয়ানমারের ভাসমান রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের উদ্ধারে আরও ক’দিন সময় লাগবে। বিশাল সাগর এলাকায় মালয়েশিয়ার চারটি জাহাজ ও হেলিকপ্টার এদের তল্লাশি ও উদ্ধারে নিয়োজিত রয়েছে। শনিবার আন্দামান সাগর থেকে নতুন করে কোন অবৈধ অভিবাসী উদ্ধারের তথ্য পাওয়া যায়নি। আশ্রয় শিবিরেও দুর্দশা ॥ মালয়েশিয়ার আচেহ প্রদেশের বিভিন্ন শিবিরে যেসব রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী নাগরিকদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে তারা এখনও দুর্দশাগ্রস্ত। সেখানকার গণমাধ্যম সূত্রে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে আশ্রিতদের খাদ্য ও ওষুধপত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু এদের শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ যে সুস্থ হয়ে উঠতে সময় নেবে। এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এদের অবস্থান এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায়নি। এদের প্রতিনিয়ত তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। যে দেশ নাগরিকত্ব দেবে সেদেশে যাবে ॥ সাগরপথে পাচারের শিকার হয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে বিদেশী গণমাধ্যম কর্মীদের জানানো হয়েছে, পৃথিবীর যে সব দেশ তাদেরকে নাগরিকত্ব দেবে তারা সেদেশে যেতে রাজি আছে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের অনেকে সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের মিয়ানমারে পাঠানো হলে মৃত্যু তাদের অবধারিত। এছাড়া গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে সে দেশের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে এমন খবর পেয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এদেশ তারা চেনে না নামও শুনেনি। তবে নাগরিকত্ব দিলে তারা সে দেশেও যাবে। ৩ মানবপাচারকারী দালাল গ্রেফতার ॥ শনিবার টেকনাফে দুই মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের একজন মোঃ ইউসুফ ও অপরজন রুবেল। পুলিশ জানিয়েছে, ইউসুফের বাড়ি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা গ্রামে। পুলিশের মতে, ইউসুফ মূলত দেশে এবং বিদেশে থাকা আত্মীয়দের মাধ্যমে মানবপাচারের সমন্বয়কের কাজ করে। এছাড়া গ্রেফতারকৃত রুবেল থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া থেকে মানবপাচারকারীদের পরামর্শ অনুযায়ী দেশে থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করত। অপরদিকে, কক্সবাজার বিজিবি সদস্যরা সৈকতে লাবনী বীচ পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে টেকনাফের লেদা গ্রামের মনির উদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায়, পুরান পল্টন পাড়ার মহিউদ্দিন এবং তার ভাইকে ফুসলিয়ে দালাল ইউসুফ তাদেরকে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেবে মর্মে জনপ্রতি দেড়লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে। যেভাবে মালয়েশিয়ায় যাত্রা শুরু ॥ সর্বপ্রথম কক্সবাজার শাহপরীরদ্বীপ হয়ে মালয়েশিয়ায় যাত্রা শুরু করেছিল ২৭ রোহিঙ্গা। একটি ইঞ্জিনচালিত বোটে করে ২০০০ সালে এ সব রোহিঙ্গাদের থাইল্যান্ডে নিয়ে যায় নৌকার মাঝি মিয়ানমারের বাসিন্দা তাজর মুল্লুক। ২০০০ সালের আগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক সেজে জাল পাসপোর্ট নিয়ে সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলে যেত। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র চালু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের এসব অবৈধ তৎপরতা রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে তাদের জন্য বিকল্প পথ হিসেবে আবিষ্কৃত হয় সাগরপথে মালয়েশিয়া যাত্রা। এরপর থেকে দলে দলে রোহিঙ্গারা এ পথে পা রেখেছে। মাঝপথে ডুবে মরেছে। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বন্দীশিবিরে আটকে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে রক্ষা পেয়েছে। টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপের বদর মোকাম ও উপকূলীয় এলাকা দিয়ে প্রথম শুরু হয়েছিল মানবপাচার। পরবর্তীতে সাবরাং, কচুবুনিয়া, কাটাবুনিয়াকে পাচারের জন্য ঘাট হিসেবে বেছে নেয়া হয়। এর পরবর্তীকে উখিয়ার সোনারপাড়া রেজু খাল পয়েন্টটি মানবপাচারের জন্য শীর্ষে চলে যায়। অর্থ লেনদেন বিভিন্ন ব্যাংকে ॥ দালাল চক্রের চিহ্নিত সদস্য মনির উদ্দিন বিজিবির কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। কক্সবাজার সতের বিজিবি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানিয়েছেন, গ্রেফতার মনির দীর্ঘদিন ধরে অপহৃত মালয়েশিয়াগামীদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। মনির জানিয়েছে, বিকাশের মাধ্যমে এবং ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, আরও বিভিন্ন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খুলে মুক্তিপণের টাকা জমা করা হতো। মানবপাচার ও ইয়াবা চোরাচালান একই সূত্রে গাঁথা ॥ চট্টগ্রামের বাঁশখালি, আনোয়ারা, গহিরাসহ উত্তর বঙ্গের অসংখ্য মানুষকে মালয়েশিয়ার পথে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাচার করা হয়েছে। মানবপাচার শেষে ফিরে আসার পথে এসব নৌকায় মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা হয় ইয়াবার চালান। মানবপাচার ও ইয়াবা চালানের গডফাদাররা একই চক্রের সদস্য। ৩২ গডফাদার ॥ বাংলাদেশে রয়েছে মানবপাচারের শীর্ষ ৩২ গডফাদার। আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী গ্রুপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের ৩২ শীর্ষস্থানীয় গডফাদার। পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় এদের নাম রয়েছে। এরা হচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারার জসিম, আহসান মাঝি, ফৌজদারহাটে মোঃ তাজউদ্দিন, হারুনুর রশিদ, মোঃ রুবেল, মোঃ নওশাদ, মোঃ খোরশেদ, মোঃ জাহেদ, মোঃ বেলাল, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রীপাড়ার সরহোছন, তাজর মুল্লুক, নুরুন্নাহার, সোনার পাড়ার নুরুল কবির, রেবি আক্তার রেবী, লম্বরীপাড়ার লার বেলাল, চ্যাপ্টাখালির ফয়েজ সিকদার, আবুল কালাম, সোনাইছড়ির শামসুল আলম, জুম্মাপাড়ার সানাউল্লাহ, বেলাল মেম্বার, হুমায়ুন রশিদ বাপ্পু, তার সহোদর রুবেল, লিংরোডের নাচির, কক্সবাজার সমিতি পাড়ার একরাম, ইদগাঁওয়ের জাফর আলম বিল্টু, নারায়ণগঞ্জের ইসমাইল, পাবনার মহসিন, হবিগঞ্জের মোঃ শহীদ মিয়া, যশোরের মোঃ মিলন হোসেন, নড়াইলের বিদ্যুত শেখ, চট্টগ্রামে বসবাসরত মিয়ানমারের আবদুল গফুর। এছাড়া ধলু হোছন যিনি ইতোমধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপে দেড় লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার ॥ শনিবার ভোরে ডুবে যাওয়া একটি ট্রলার থেকে প্রায় দেড় লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। কোস্টগার্ড সূত্রে জানানো হয়, গত বুধবার গভীর রাতে মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে ইয়াবার চালান বোঝাই করে এ নৌকাটি জলদস্যুদের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে ডুবে যায়। নৌকাটির আট মাঝিমাল্লা সাগরে ভাসতে দেখে শাহপরীরদ্বীপ এলাকার জেলেরা এদের চারজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। ঐ ট্রলারের মাঝি লোহাগাড়ার মোঃ রফিক সেন্টমার্টিনে থেকে যায়। সে গোপনে ইয়াবার চালানটি সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। গোপন সূত্রে এ খবর পেয়ে সেন্টমার্টিনের কোস্টগার্ড সদস্যরা শুক্রবার রাতে ট্রলারটি জব্দ করে এবং এতে তল্লাশি চালিয়ে ড্রামের ভেতর থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।
×